আর নয় গৃহকর্মী নির্যাতন মমিনুল ইসলাম মোল্লা

আর নয় গৃহকর্মী নির্যাতন
মমিনুল ইসলাম মোল্লা

  ৫ জুন রাজধানী ঢাকার দক্ষিনখান থানার নদী তালতলা এলাকার পরমিনা আক্তার (৯) নামে এক শিশু গৃহকর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে গৃহকর্ত্রী । (দৈনিক সংবাদ ৬ জুন)। এভাবে প্রতি বছর দেশের কোথাও না কোথাও গৃহকর্মী শিশু কিংবা নারী নির্যাতিত হয়ে মারা যাচ্ছে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দারিদ্রতা, হঠাৎ ব্যবসায় লোকসান হওয়া, নদী ভাঙ্গা, কিংবা  মা-বাবা মারা গেলে তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কাজের লোক হিসেবে অন্যের বাসায় কাজ করতে দেন। এ পরিস্থিতিতে কেউ কেউ আত্মীয়ের বাসায়  আবার কেউ কেউ পাড়া-প্রতিবেশীর বাসায় পাঠান। কেউবা  আবার দালালের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। গৃহকর্মী আনার সময় গৃহকর্তা গরীব মা বাবাকে বলেন-”আপনার মেয়ে আমার বাসায় আমার মেয়ের মতই থাকবে। আমরা যা খাই সে তা-ই খাবে। কয়েক দিন পর পর নতুন জামা কাপড় কিনে দেব, ও আরামেই থাকবে। ওকে নিয়ে কোন টেনশন করবেন না। মাঝে মাঝে গিয়ে খবর নেবেন।”একটি সাধারণ পরিবারেও যদি একটি কাজের লোক রাখা হয় সে পরিবারের গৃহকর্ত্রী নিজেকে বস মনে করেন।  তার মধ্যে প্রভুত্বমূলক মনোভাব দেখা যায়। ফলে তাদের চরিত্রে পাশবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। গৃহকর্তাও কাজের ছেলে বা মেয়েটিকে দাস-দাসীর মতো মনে করেন। কাজে-কর্মে, আচার  আচরণে, খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করেন। মূলত গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্মীর সম্পর্ক দুজনের কারণেই খারাপ হতে পারে। গৃহকর্ত্রী নিজেকে রাণী এলিজাভেথ ভেবে পায়ের উপর পা রেখে শুধু আদেশ করলেই চলবেনা। মানবাধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কৎর্মকর্তা, সচিব, পুলিশ, সামরিক কর্মকর্তা, ডাক্তার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশাজীবির বাসায় এ কধরণের ঘটনা বেশি ঘটছে।

পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্যানুযায়ী ২০১০ সালে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৪২৯ টি শিশু । ২০১১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত নির্যাতিত হয়েছে ৩৯১ জন। আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)এর মতে গত ৫ বছরে ৩৯৩টি শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনে মারা গেছে। অত্যাচার সইতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছে। সারা দেশে প্রতি বছর কতজন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয় এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। রাজধানীর তেঁজগাঁও পুলিশের ভিকটিম সেন্টারে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রæয়ারি থেকে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে ৭৯৪ নারী ও শিশু। ৪৩৮ জন নিখোঁজ হয়েছে। অথবা বাসা থেকে পালিয়েছে।  নির্যাতনের পর সরাসরি উদ্ধার হয়েছে ১২জন। মহানগর পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আশ্রিতদের মধ্যে অন্তত ২০০ ছিল গৃহকর্মী। আইএলও ও ইউনিসেফের এক জরিপে (২০০৭) দেখা যায়, দেশে ৬ থেকে ১৭ বছর বয়সের শিশু শ্রমিকের সংখ্যা চার লাখ ২০ হাজার। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জাতীয় জরিপে দেখা যায় শিশু  গৃহকর্মীর ৮০ শতাংশই মেয়ে। বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর গড়ে ৪৪ জন গৃহকর্মী নিহত হচ্ছে। ২০০১-২০১০ পর্যন্ত নির্যাতিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ৩৯৮ জন ।দেশে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ গৃহকর্মী রয়েছে।
গৃহকর্মীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে রয়েছে বকা-ঝকা করা,  খোটা দেয়া , বিশ্রামের সুযোগ না দেয়া, অসুস্থ অবস্থায় কাজ করানো, বাবা মা তুলে গালমন্দ করা, পেট পুড়ে খেতে না দেয়া,  পঁচা ও বাসি খাবার খেতে দেয়া ইত্যাদি। এছাড়া ঝারু দিয়ে পেটানো,  তরকারি নাড়ার কাঠি দিয়ে পেটানো,  ঢেউয়া দিয়ে আঘাত করা, মাছ উল্টানোর স্টিক দিয়ে পেটানো, চোখে মরিচ লাগানো, বেত দিয়ে পেটানো, আগুনের সেঁকা দেয়া, হাত পায়ের নখ তুলে ফেলা, মাথা ন্যাড়া করা, বাথরুমে আটকে রাখা, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা, ও যৌনাঙ্গে আঘাত করার মাধ্যমে গৃহকর্ত্রীরা কাজের মেয়েদের শাস্তি দিয়ে থাকে। নির্যাতনের ফলে কান্নার আওয়াজ যাতে প্রতিবেশীরা শুনতে না পায় সেজন্য তারা তাদের মুখে কাপড় গুঁজে দেয় অথবা জোর ভলিউমে গান বাজায়।
কাজের মেয়েদের প্রতি যেসব নির্যাতন চালানো হয় সেগুলোর মধ্যে যৌন নির্যাতন অন্যতম। যৌন নির্যাতনের কারণে মেয়েটি গর্ভবতী হলে তাকে কৌশলে হত্যা করা হয়। অথবা মেয়েটিকে ভ্রষ্ঠা ঘোষণা দিয়ে বহিষ্কার করা হয়। কেউ এর প্রতিবাদ করলে টাকা দিয়ে অথবা ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৯১ সালে ”শৈশব বাংলাদেশ” নামে একটি সংগঠন ১ু১৪ জন ভাসমান যৌনকর্মীর উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে তাদের মধ্যে ১০০ জনই এক সময় গৃহকর্মে নিয়োজিত ছিল। গৃহকর্তা বা অন্য কারো মাধ্যমে ধর্ষিত হয়ে এ পথে আসতে বাধ্য হয়েছে। হাসপাতাল ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে-রাজধানীতে ২০১০ সালের মে-নভেম্বর এই ৭ সাসে ১১৭টি অপমৃত্যুর ঘটনায় ৬৯ জনই ছিল গৃহকর্মী। অধিকাংশক্ষেত্রে পুলিশ আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করে ”গৃহকর্মী মানবিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলও গলায় রশি বেঁেধ ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রতীয়মান। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে বাড়ির গৃহকর্তা, ছেলে অথবা অন্য কারো কারো দ্বারা  যৌন নির্যাতন চালানোর কারণে বিপর্যেস্তের সংখ্যা বেশি। নির্যাতিত গৃহকর্মীদের জবানবন্দী নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২২ ধারায় নেয়া হয়। তবে এ জবানবন্দী নেয়ার সময়ও অনেক সময় প্রভাব বিস্তার করা হয়। পরিকল্পিতবাবে গৃহকর্মী হত্যার ঘটনা কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে অধিক প্রহারের কারণে এরা মারা যায়। মারা যাওয়ার পর তারা এ মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। তখন কেউ বলে জন্ডিসে , কিডনি রোগে অথবা ডায়রিয়ায় মারা গেছে। মেয়ের মা-বাবাকে বলা হয় , হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা গেছে। কেউ কেউ আবার মুমূর্ষৃ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করে রোগীর অবস্থা খারাপ দেখলে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। আইন ও সালিস কেন্দ্রে সূত্র জানায়-”অধিকাংশ মামলা হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪(খ) ধারায়। এতে সাজা দেয়ার সুযোগ কম। এতে শুধু দাহ্য পদার্থ দ্বারা আহত করলে শাস্তি দেয়া যায়। কিন্তু বেত্রাঘাত , গরম খুন্তি, লোহা, ইস্ত্রিও ছেকা, গরম পানি ঢেলে দেয়াজনিত অপরাধের সাজা দেয়া যায় না। দন্ডবিধি ২৩, ২৪, ২৫, ২৬ অনুযায়ী মামলা করা উচিত। কোন সময় মিডিয়ায় আসলে অথবা মামলা মোকদ্দমার সম্মুখীন হলে তারা তাদের অর্থ ও সামাজিক কিংবা প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে তা চাপা দেয়া হয়।  বিচার ও শাস্তি থেকে তারা নিরাপদে থাকে। ফলে খুন নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। ফলে আমাদের সমাজ ও সভ্যতা কলুষিত হচ্ছে।
কবি বলেছেন বিশ্রাম কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা , নয়নের অঙ্গ যেন নয়নেরই পাতা। এ কথাটি যেমন আমার -আপনার জন্য সত্য তেমনি গৃহকর্মীদের জন্যও সত্য। ইলেকট্রনিক্স মেশিন ও একাধারে চালালে গরম হয়ে যায়। আপনি যদি মনে করেন তাকে তো কাজ করার জন্যই আনা হয়েছে। সুতারং আমি ঘুমানোর সময় মশারির ৩ কোণা টাঙ্গিয়ে ১ কোণার দড়ি ধরে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলব ,তাহলে আপনার এ চাওয়াটি অতিরিক্ত। তাকে দিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম না করিয়ে যদি মাঝে মাঝে বিশ্রাম দেয়া যায় তাহলে ফল ভাল পাওয়া যায়। কেননা তার শরীরও বিশ্রাম চায়, আরো চায় আনদ পেতে, বাইরে ঘুরতে ও ভাল খাবার খেতে। চিন্তা করে দেখুন, তারাইতো বাসার সব কাজ করে; ইচ্ছে করলে তাদেরকে কি দুপুরে খাওয়ার পর একটু ঘুমুবার সুযোগ দেয়া যায় না? তারা কখন কি কাজ করবে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিলে দেখবেন মনের আনন্দে কাজ করবে। পত্রিকার পাতা উল্টালেই আমরা গৃহকর্মী নির্যাতনের সংবাদ দেখতে পাই। এগুলো পড়ে চিন্তা করি আমরা কোন যুগে বাস করছি? মানুষের উপর মানুষ এতটা হিং¯্র হয় কিভাবে? কোথায় শিক্ষা,  কোথায় ধর্ম, কোথায় মানবতা? কোথায় সভ্যতা? কোথায় মমত্ববোধ? আমরা কি সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছি? এ অপরাধের দায় ভার আমাদেরকেও বইতে হবে। এ অপরাধ রোধ করার দায়িত্ব আমার , আপনার, তথা সমাজের বিবেকবান মানুষের।লেখকঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য ক্যাম্পেনার। 


Post a Comment

0 Comments