হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্রতা লাভ
মমিনুল ইসলাম মোল্লাইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি মেয়ে ৯ থেকে ১২ বছর বয়সের মধ্যে বালেগ হয়। বালেগ হওয়ার পর তার উপর নামাজ- রোজা ফরজ হয়। এসময় তার হায়েজ শুরু হয়। হায়েজ থেকে পবিত্রতা অর্জণ জরুরি। মহিলারা মোটামোটি ৫০ বছর পর্যন্ত সন্তান ধারণের উপযোগী। এ সময় প্রতি মাসে হায়েজ ও সন্তান প্রসবের পর নিফাসের মুখোমখি হয়। হায়েজের মতো নিফাস থেকে ও পবিত্রতা অর্জণ করা আবশ্যক।
আমাদের দেশের মহিলাদের এ সম্পর্কে জ্ঞান-অর্জণের সুযোগ কম। না জানার কারণে তারা পাপের কাজ করে থাকে। মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষদের এ বিষয়টি জানা প্রয়োজন। আপনার স্ত্রী যদি আপনাকে এব্যপারে জিজ্ঞেস করে তাহলে আপনাকেই সঠিক জবাব দিতে হবে। তছাড়া হায়েজ নিফাসের সময় এমন কিছু কাজ করা নিষেধ যা করলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই গুনাহগার হবেন। মায়ের গর্ভে শিশুর খাদ্য যোগানোর জন্য মাসিক ঋতু¯্রাব সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গর্ভবতী মায়েরা মাসিক ঋতু ¯্রাব থেকে মুক্ত থাকেন। সন্তান প্রসবের পর সেটি আল্লাহ মায়ের স্তনে দুধের উৎসে রুপান্তিরিত করেন। তাই দুগ্ধদানকালে তারা সাধারণত মাসিক ঋতু¯্রাব থেকে মুক্ত থাকেন। সাধারণত প্রতি মাসে ৬/৭ দিন ঋতু ¯্রাব হয়ে থাকে। এসময় জরায়ুর ভেতরের অংশ থেকে হলুদ , মেটে বা ঘোলা রঙের রক্ত বের হয়ে থাকে। জরায়ুর “ আযর ” থেকে এ রক্ত বের হয়। রক্তের বৈশিষ্ট হচ্ছে এটি দুর্গন্ধযুক্ত, ঘন, কালো, এবং বের হওয়ার পর তা জমাট বাঁধে না। তবে মাসিকের নির্দেষ্ট সময়ের আগে পরে হলে অন্য কিছু ভাবতে হবে। এসময় সে অন্যান্য মহিলাদের মতো সালাত আদায় করতে হবে। মাসিক ঋতু¯্রাবের ব্যাপারে কোরানে আল্লাহ বলেন- লোকেরা তোমাকে হায়েজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, বল তা হলো অপবিত্রতা। সুতরাং হায়েজ অবস্থায় স্ত্রীদের থেকে দূরে থাক। আর তবে পাক হওয়ার পূর্বে তাদের সাথে মিলিত হয়ো না। তকে পাক-পবিত্র হলে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তাদের কাছে যাও। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালবাসেন। তিনি পবিত্রতা রক্ষাকারীদেরও ভালবাসেন। ( সুরা বাকারা )
হায়েজ অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধঃ সালাত অদায়, রোজা রাখা, কুরআন মজিদ স্পর্শ করা, মসজিদে প্রবেশ করা, স্বামী সহবাস, কাবাঘর তাওয়াফ করা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক প্রদান। ইমাম আবু হানিফার মতে, যে ওয়াক্তে পবিত্র হবে শুধু ঔ ওয়াক্ত থেকেই নামাজ শুরু করবে। অর্থাৎ আসরের ওয়াক্তে হায়েজ বন্ধ হলে গোসল করে শুধু আসর পড়বে। এর আগের ওয়াক্ত থেকে শুরু করার দরকার নেই। হায়েজের সময় স্ত্রী সহবাস নিষিদ্ধ জেনেও যারা তা করলো তাহলে তারা কুফরি করলো। ( তিরমিযি ) হায়েজ ও নিফাস অবস্থায় যে সব কাজ বৈধঃ হায়েজওয়ালা স্ত্রীর সাথে স্বামীর গা লাগানো, একত্রে শয়ন করা। স্ত্রীর হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত ঢেকে রাখা আবশ্যক। মু,আয ইবনে ফাযাল (রঃ) বলেন উম্মে সালমা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক সময় আমি ও রসুল ( সাঃ ) একই চাদরের নিচে শুয়েছিলাম। আমার হায়েজ শুরু হলো। তখন আমি চুপিসারে বেরিয়ে এসে হায়েজের কাপড় পড়ে নিলাম। রাসুল্লাহ ( সাঃ ) আমাকে বল্লেন, তোমার কি হায়েজ শুরু হয়ে গেছে ? আমি বল্লাম হ্যা, তিনি আমাকে ডেকে নিলেন এবং আমি তাঁর সঙ্গে একই চাদরের নিচে শুয়ে পড়লাম। (বুখারি,খন্ন্ড১,হা/ ৩২০ ) একই গøাস বা প্লেটে আহার করা যাবে। ঋতুমতি স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে কুরঅন পাঠ করতে কোন দোষ নেই। এসময় মহিলারা তাদের স্বামীর খেদমত করতে পারবে। আহমদ ইবনে ইউনুস (রঃ) বলেন, আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ ) বলেছেনঃ হায়েজ দেখা দিলে সালাত ছেড়ে দাও। হায়েজের সময় শেষ হয়ে গেলে রক্ত ধুয়ে নাও এবং সালাত আদায় কর।” (বোখারি খন্ড-১ /৩২৭)
মহিলারা সন্তান প্রসবের পর প্রসবের রাস্তা দিয়ে যে রক্ত বের হয় তাই নিফাস নামে পরিচিত। নিফাসের সময়কাল সাধারণত ৪০ দিন। তবে কোন কোন সময় তা ৬০ দিনও হতে পারে। কেউ কেউ ৪০ দিনের আগেই মুক্ত হয়ে যেতে দেখা যায়। এ অবস্থায় ৪০ দিন অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তরল পদার্থ দেখা না গেলে সাথে সাথে গোসল করে পবিত্র হয়ে আগের মতো সব ধরণের কাজ-কর্ম করতে পারবেন। ৪ মাস পূর্ণ হওয়ার পর কারও পেটের বাচ্চা গর্ভপাত হয়ে গেলে যে রক্ত বের হবে তা নিফাস বা প্রসূতির রক্ত। তবে আকৃতিবিহীন রক্ত বা গোশত বের হলে প্রসূতি বলে গন্য হবে না। হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত, এক মহিলা রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) কে হায়েজের গোসল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি তাকে গোসলের নিয়ম বলে দিলেন যে, এক টুকরা কস্তুরি লাগানো নেকড়া দিয়ে পবিত্রতা হাসিল কর। মহিলা বল্লেন, কিভাবে ? রাসুলুল্লাহ সাঃ বল্লেনঃ তা দিয়ে পবিত্রতা হাসিল কর। মহিলা ( তৃতীয়বার ) বল্লেন, কিভাবে ? রাসুলুল্লাহ (সাঃ ) বল্লেন সুবহানাল্লাহ ! তা দিয়ে পবিত্রতা হাসিল কর। “ আয়েশা ( রাঃ ) বল্লেন, তখন আমি তাকে টেনে আমার কাছে নিয়ে আসলামএবং বল্লামঃ তা দিয়ে রক্তের চিহ্ন বিশেষভাবে মুছে ফেল।” ( বুখারি,খন্ড ১, হা/৩১১ )
গর্ভবতী মহিলার যদি অনেক রক্ত¯্রাব হওয়া সত্বেও গর্ভপাত না ঘটে তাহলে তা মাসিকের রক্ত না ভেবে রোগ জনিত রক্ত ভাবতে হবে। এসময় সাওম সালাত, কোনটাই বাদ দেয়া যাবে না। এ অবস্থাকে ইস্তিহাযা বলে। ইস্তিহাযা হচ্ছে মহিলাদের জরায়ুর নিকটবর্তী “ আযেল ” নামক স্থান থেকে নির্গত রক্ত। এর রঙ লাল, পাতলা ও দুর্গন্ধযুক্ত নয়। সবচেয়ে বড় পার্থক্য এ রক্ত বের হওয়ার পর তা জমাট বেঁধে যায়। এসময় নামাজ পড়তে হবে। ইব্রাহিম ইবনে মুনযির আল হিযামি (রঃ ) বলেন, নবি পতœী আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, উম্মে হাবিবা ( রাঃ ) সাত বছর পর্যন্ত ইস্তিহাযাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি এব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞস করলেন। তিনি তাকে গোসলের নির্দেশ দিলেন এবং বল্লেন এটি শিরা নির্গত রক্ত। এরপর উম্মে হাবিবা ( রাঃ ) প্রতি সালাতের জন্য গোসল করতেন। (বুখারি খন্ড ১ হা/৩২৬ ) হায়েজ থেকে পাক-পবিত্র হওয়ার জন্য অবশ্যই ফরজ গোসল করতে হবে। যে কয়টি কারণে গোসল ফরজ হয় তার মধ্যে হায়েজ-নিফাস, সপ্নদোষ, সহবাস অন্যতম। হায়েজের গোসল জানাবতের গোসলের মতো। হাদিসে আছে, রসুল (সাঃ ) প্রথমে তার লজ্জাস্থান পরিষ্কার করে নিতেন তারপর নিয়ম অনুযায়ী গোসল করতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (রঃ) বলেন মা আয়েশা থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ যখন জানাবতের গোসল করতেন , তখন প্রথমে তার হাত দুটো ধুয়ে নিতেন । তাঁরপর সালাতের ওযুর মতো ওযু করতেন। তারপর তার আঙ্গুলগুলো পানিতে ডুবিয়ে নিয়ে চুলের গোড়া খিলাল করতেন। তারপর তার উভয় হাতের তিন আঁজলা পানি মাথায় ঢালতেন। তারপর তাঁর সাড়াদেহে পানি পেীঁছে দিতেন। ” (বুখারি,খন্ড১ হা/ ২৪৮) ঋতু¯্রাব শেষ হয়েছে কিনা তা জানার জন্য ঋতৃ¯্রাবের যায়গায় এক টুকরা সাদা তুলা বা প্যাড দিয়ে রাখবে। এরপর তা বের করার পর যদি টুকরাটির কোন পরিবর্তন দেখা না যায় তাহলে বুঝতে হবে সে পবিত্র হয়ে গেছে। রক্ত পড়া বন্ধ হলেও সুন্নত মোতাবেক গোলল না করা পর্যন্ত সহবাস করা হারাম। এছাড়া সহবাসের সময় পায়খানার রাস্তা ব্যবহার করা নিষেধ। নিষিদ্ধ অবস্থায় বা নিষিদ্ধ পথে সহবাস করলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই গোনাহগার হবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে মুসলমান হিসেবে আমাদরকে সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে। আমরা যেন কুরআন-ও সহিহ হাদিস মোতাবেক সকল কাজ করে আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলকে খুশি করতে পারি, আল্লাহ আমাদেরকে সে তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক , সাংবাদিক, ধর্মীয় গবেষক, কুমিল্লা।

0 Comments