কৃষিতে শ্রমিক সঙ্কট রোধে নারী
মমিনুল ইসলাম মোল্লাবোরো ধান কাটার মৌসুমে প্রতি বছর কৃষিতে শ্রমিক সংকট দেখা যায়। বর্তমানে নারীরা শ্রমিকদের শূণ্যতা পূরণ করছে।চলনবিলসহ দেশের সকল যায়গার নারীরা কম-বেশি কৃষি কাজে নিয়োজিত । তারা সবাই ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত।কাস্তে হাতে ধান কাটা ,ধানের আটি মাথায় করে মালিকের বাড়ি নিয়ে যাওয়াসহ সকল কাজ তারা করছেন।ধান সিদ্ধ করা, শুকানোসহ সকল কাজে তারা নিয়োজিত থাকছেন।
২০০২-০৩ সালের তুলনায় বর্তমানে কৃষি -বন ও মৎস্য খাতে পুরূষ শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে ১০.৪ শতাংশ।১৯৯৯-২০০০সময় কাল থেকে ২০০৫-২০০৬ সময়কাল থেকে সব খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৪০ লাখ।ফসলের মৌসুমে পুরুষ শ্রমিকের সংকটকালে উত্তরাঞ্চলের নারীরা কৃষি শ্রমিকের চাহিদা মেটাচ্ছেন।১৯৯৯-২০০০ সময়কাল থেকে ২০০৫-২০০৬ সময়কালে কৃষি-বন ও মৎস্য খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২৩ লক্ষ থেকে বেড়ে ৭৭ লক্ষ হয়েছে।অর্থাৎ ১০.৮ শতাংশ বেড়েছে।সেসময় পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে ২.৩ শতাংশ।২০০২-২০০৩ সময়কালের তুলনায় কৃষি বন ও মৎস্য খাতে পুরুষ শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে প্রায় ১০.৪ শতাংশ। সিএসআরএল”র ২০১২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৮১ শতাংশ নারী গৃহকর্মে সরাসরি অবদান রাখছেন। পুরষ শ্রমিকদের কৃষিতে সারা বছর কাজ থাকেনা, ফলে তারা কৃষি ছেড়ে অন্যান্য পেশায় চলে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য যায়গায় কৃষি শ্রমিক হিসেবে মজুুরি বেশি থাকায় এসব অঞ্চলের পুরুষ শ্রমিকরা অন্যত্র চলে যায়। কৃষি কাজে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও এব্যাপারে সরকার কোন বিশেষ পদক্ষেপ নেয়নি।দেশে কৃষি নারীর সংখ্যা কত তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অফিসারের কাছে নেউ।রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে প্রদত্ত ১ কোটি ৩৯ লক্ষ কৃষক কার্ড বিতরণ করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলতে অপারগ কতজন কিষানী ”কৃষক কার্ড ” পেয়েছেন। কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণকে স্বাগতম জানানোর প্রয়োজন থাকওলেও তারা উল্টো মজুরী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না।ফলে তারা আশাহত হচ্ছে।
আগে আদিবাসী নারীরা শ্রমিক হিসেবে মাঠে কাজ করতো।বর্তমানে মুসলমান ও হিন্দু নারীরা ও কাজ করছে। বাংলাদেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ লোক বাড়তি শ্রমশক্তি যুক্ত হয়েছে।এর মধ্যে প্রায় ৫০ লাখই নারী শ্রমিক ।১৯৯৯-২০০০ সাল থেকে ২০০৯ -২০১০সময়ে কৃষি -বন ও মৎস্য খাতে অংশগ্রহণকারী নারীর সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে।শ্রম শক্তি জরিপ ২০০৫-২০০৬ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছরের মোট শ্রম শক্তির ৪৮.১ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত ।পুরুষ শ্রমশক্তির ৪১.৮৮ শতাংশ , নারী শ্রম শক্তির ৬৮.১ শতাংশ কৃষির সাথে সরাসরি যুক্ত।শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ।এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ কৃষি কাজের সাথে জড়িত।অর্থাৎ মোট নারী শ্রমিকের মধ্যে ৯২ লাখ কৃষি কাজের সাথে জড়িত।কর্মজীবি নারী সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে-উওরের ১৬ জেলায় প্রায় ৩ লাখ নারী কৃষি শ্রমিক হিসেবে বছরের পর বছর পারিশ্রমিক নিয়ে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।তারা তাদের ন্যায্য মজুুরি চান। কুমিল্লার জোৎ¯œা বেগমের (৩৩)স্বামী মারা গেছেন।স্বামীর সামান্য জমি দিয়ে তার সংসার চলে না।প্রথমত বাড়ির ভেতরের চাচী-জ্যাঠীদের টুকটুাক কাজ করে দিতেন।বর্তমানে পুরুষ শ্রমিকদের মতো সকল কাজ করছেন।রংপুরের গঙ্গাচড়ার কিসমত বেগম (৩৫)দু সন্তানের জননী।দীর্ঘদিন ধরে স্বামী তার খোঁজ খবর নেয়না।মাঠে কাজ করে কোনমতে দিন চলে।সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে সে পায় ৮০ টাকা , পুরুষ শ্রমিক পায় ১৫০ টাকা।ধান কাটা, আটি বাঁধা , মাথায় করে বাড়িতে আনা, ধান মাড়া, ধান উড়ানো ,ভেজানো, সিদ্ধ করা, শুকানো, গোলায় তোলা, চাল বের করা,বোরো লাগানোর মৌসুমে ধানের চারা লাগানো,সার দেয়া , আগাছা নিধন, কীটনাশক ছিটানো, ধান ঝাড়া, কুড়া বের করা,ধোয়া ,রান্না করার কাজ তারা করেন ।বোরো মৌসুমে কৃষকদের সাথে কিষাণীরাও ব্যাস্ত থাকেন।তাদের সাহায্য ছাড়া ধান গোলায় তোলা দুষ্কর । কিষানীরা হয়তো পারিশ্রমিক পান না।সংসারের সচ্ছলতার জন্য সোনালী ধান ঘরে তুলতে ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করে যাচ্ছেন।গ্রামীণ জীবনযাত্রায় স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারভিযানের (সিএসআরএল) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শ্রমবাজারে নারী অধিকতর অংশগ্রহণ থাকলেও নিয়োজিত নারী শ্রমিকের ৭২ শতাংশ হলো অবৈতনিক পারিবারিক নারী শ্রমিক ।৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষি সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের স্বিকৃতি নেই।রাষ্ট্রূীয় স্বীকৃতি না থাকায় জমি প্রস্তুতকারক , সার সেচ ব্যবহার সংক্রান্ত সরকারি সেবা ও ভর্তুুূকীগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।নারী শ্রমিক সহজলভ্য হওয়ায় তাদের মজুুির কম।চলন বিলের নারী শ্রমিক মুুক্তি রাণী ওরাও বলেন- তারা যে কৃষকের ধান কাটছেন সেখানে পুরুষ শ্রমিকরা প্রতিদিন যে পরিমান ধান কাটেন তারাও সে পরিমাণ ধান কাটেন কিন্তু পারিশ্রমিকের বেলায় তাদের পুরুষের চেয়ে কম টাকা দেয়া হয়। দারিদ্রতার কারণে নারী কৃষি শ্রমিকরা কম দামে অগ্রিম শ্রম বিক্রি করে দেয়।ফলে পুরুষ শ্রমিকদের মজুুরি ক্রমাগত বাড়লেও মহিলা শ্রমিকদের মজুুরি তেমন বাড়ছে না।আগে পুরূষ শ্রমিকের দৈনিক মজুুরি ছিল (গড়)২০০ থেকে ২৫০ টাকা ,নারী শ্রমিকের মজুুরি ছিল ১৫০/২০০ টাকা, বর্তমানে পুরুষের মজুুির ৩৫০-৪০০ টাকা আর মহিলাদের মজুুরি ৩০০-৩৫০ টাকা। শুধু মাত্র কৃষি নয় ুবিুিল।দালান নির্মাণ, সড়ক মেরামত, মিল, চাতাল, উ টভাটাসহ সব যায়গায় তারা মজুুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।বর্তমানে বোরো ধান ঘরে তোলার কাজে নারী শ্রমিকগণ নয়োজিত ।তাছাড়া তারা বীজ সংরক্ষণ, নার্সারী ব্যবসা, পাটের আঁশ ছড়ানো , সব্জি উৎপাদন, ফুল-ফল ও সব্জী উৎপাদন চিংড়ি চাষ,হাঁস-মুরগি পালন,ও কুুটির শিল্পে তারা শ্রম দিচ্ছেন।কিছু দিন আগে আলু মৌসুমে নারীরা আলু ক্ষেতে কাজ করেছে।আলু ঘরে তোলার কাজে তারা সহযোগিতা করেছে।তাছাড়া আলু লাগানো, আগাছা নিধন, গাছের পরিচর্যা সব কাজ তারা করেছে।সিলেটের চা বাগানগুলোতে যুগ যুগ ধরে অবাঙ্গালী নারী শ্রমিকরা কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৪৮ সালের মানবাধিকার আউনের ৪৮ ধারায় বলা হয়েছে প্রত্যোক শ্রমিকের বিশ্রাম ও অবসর বিনোদনের অধিকার রয়েছে।কাজের সময় যুুক্তিসংগত সীমা, ও বেতনসহ নৈমিত্তিক ছ ুটি ও অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।বিশ্বব্যাংক পরিচালিত ”নারী ব্যবসা ওবেং আউনি২০১২” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, দৈনন্দিন কাজের ৬৬ শতাংশ করেন নারীরা খাদ্যের ৫০ শতাংশ তারা উৎপাদন করেন।অথচ তারা কর্মের মজুুরি পান১০ শতাংশ।” কৃষি শ্রমিকদের মজুুরির ব্যাপারে ১৯৮৪ সালে ১টি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।কিন্তু অধ্যাদেশটি কার্যকর করা যায়নি।নুন্যতম মজুুরি শ্রমের মূল্য নির্ধারণ কাউন্সিল গঠিত না হওয়ায় অধ্যাদেশটি মূলত অকার্যকর রয়েছে বলে জানা যায়। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে বিভিন্ন সুযোগ সুুবিধাসহ সমান পারিশ্রমিক , ১ক মানের কাজের ক্ষেত্রে সম-আচরণ,সে সঙ্গে কাজের মান মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে সমান আচরণের অধকারী।কৃষি নারী শ্রমিকরা স্থানীয় সরকার প্রশাসন কর্র্তৃক পরিচয়পত্র প্রদান, তালিকা প্রনয়ন, মজুুরি নির্ধারণ, ুনিবন্ধন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে, বিশেষ সহযোগীতা, কল্যাণ তহবিল গঠন, সমমজুুরি প্রদান, ও স্থায়ী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুুবিধা নশ্চিতকরনের দাবী জানান। নারী নেত্রী শিরিন আক্তার বলেন-নারী কৃষি শ্রমিকদর শ্রম আ নের আওতাভ ূক্ত করতে হবে।কৃষক হসেবে তার প্রাপ্য সুযোগ সুুবিধা নিশ্চিত না করানো ও দেশের উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়বে।নারী অধিকার মঞ্চের নেতৃবৃন্দ বলেন-সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূর করার প্রত্যয়ে ৮ মার্চ আনর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলেও কৃষি কাজের সাথে জড়িত নারী শ্রমিকেরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।রংপুরের ক্ষেত মজুর সমিতিসহ অন্যান্য সংগঠন নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরীর দাবিতে সোচ্চার।তারা স্থানীয়ভাবে সভা-সমাবেশ, মানবন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসুুচি পালন করে। শ্রমিক নেতারা ভিন্ন সময়ে তাদের দাবী দাওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি প্রদান করে।তারা সারা বছরের কাজ , খাদ্যের নিশ্চয়তা পল্লী রেশনিং ব্যবস্থা স্বল্প মূল্যে চাল, আটা, তেল, চিনি, ও কেরোসিন সরবরাহের দাবী জানায়। ।লেখকঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য ক্যাম্পেনার।
0 Comments