নারীনীতি নিয়ে কিছু কথা

নারীনীতি নিয়ে কিছু কথা

নর-নারীর সমন্বয়ে পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি এমনকি গোটা পৃথিবী গঠিত।ইসলাম ধর্ম মতে, অল্লাহ প্রথম মানব হিসেবে  হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টি করেন। তারপর তার একাকিত্ব ঘুচানোর জন্য  মা হাওয়া (আঃ) কে দুনিয়াতে পাঠান। তাই নর-নারী একই বৃন্তের দুটো ফুল। সেজন্য কাউকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা। এজন্য সরকার নারীনীতি-২০১১ প্রনয়ন করেছে। এবিষয়ে মৌলবাদী গোষ্ঠিী ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অন্যদিকে নারীবাদীরাও অনড়, তারা চান যেভাবেই হোক নারী নীতি বাস্তবায়ন করা হোক।

বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে মহিলা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার রয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলেও মহিলা নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি। তাই বাংলাদেশে মহিলাদের কোন সমস্যা  থাকার কথা নয়। মহিলাদের মর্যাদা ও অধিকার বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ একটি মডেল রাষ্ট্রে পরিনত হতে পারে। কিন্তু যখনই সরকার নারীদের জন্য ভাল কিছু করতে চায় তখনই মৌলবাদী  গোষ্ঠি  তাতে হস্তক্ষেপ করে। ইসলামের ধোঁয়া তুলে জনগনকে বিভ্রান্ত করে সরকারের কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করে। এবারও তারা নারী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করা হবেনা। তবুও তারা যুক্তি মানছেন না।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জাতীয় ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডে নারীর ক্ষমতাও অধিকার নিশ্চিত করে নারী উন্নয়ন নীতিমালা মন্ত্রীসভা অনুমোদন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ নীতিমালার অনুমোদন দেয়া হয়।
৪৯টি ধারায় নারীদেও আথর্- সামাজিক ,প্রশাসনিক অধিকার ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। এ নীতিমালার প্রথম ভাগে ১৫টি ধারা স্থান পেয়েছে। এগুলার মধ্যে নারীদের উন্নয়ন পরিকল্পনা, বৈষম্য , পারিবারিকসহিংসতা, দারিদ্র ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে- মানবাধিকার, কন্যা শিশুর উন্নয়ন, দারিদ্র দূরিকরণ,  খাদ্য নিরাপত্তা, স¦াস্থ্য ও পুষ্টি, প্রতিবন্ধিত্ব, গণমাধ্যম। এছাড়া তৃতীয় ভাগে বলা হয়েছে-নারী উন্নয়নে এনজিও ও সামাজিক সংগঠন,  প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান,  আর্থিক ব্যবস্থা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, এবং  আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কথা।
নারী নীতির ৪৯টি ধারার মধ্যে মাত্র দুটি ধারা মৌলবাদী গোষ্ঠির আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দুটি ধারা হলো ২৩/৫ এবং ২৫/২। প্রথমটিতে বলা হয়েছে-”সম্পদ,  কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া”।  দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে-”উপার্জন, উত্তরাধিকার , ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা”।
বাংলাদেশের কয়েকটি ইসলামিক দল সবসময় নারীনীতির বিরোধিতা করে আসছে। প্রথমে তারা পৃথক পৃথক ভাবে বিবৃতি দিলেও পরবর্তীতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছে। এসব দলের মধ্যে রয়েছে-কওমী মাদ্রাসা বেফাকুল মাদ্রাসিল আরাবিয়া, ইসলামি আইন বাস্তবায়ন কমিটি, ওলামা মাশায়েখ পরিষদ, খেলাফত মজলিশ ও ইসলামি শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন।
৮ মার্চ নারীনীতি ঘোষণার পর থেকেই ইসলামিক দলগুলো এর বিরূদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।তারা নারী পুরুষের সমান অধিকার মেনে নিতে নারাজ। কারণ ইসলামে এর সমর্থন নেই। সরকার এটি করতে চাইলে সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর হুমকিদেন।
সাধারণ  গৃহীনিরা বর্তমান নারী নীতিতে খুশি। তবে তারাও কোরআন সুন্নাহ বিরোধ ী  আইন মেনে নিতে নারাজ। তবে বাকী বিষয়গুলোর প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন রযেছে। কুমিল্লার গৃহীনি আফরোজা রোজা বলেন-আল্লার সুস্পষ্ট নির্দেশ অমান্য করে সম্পত্তিতে নারী পুরুষের সমান ভাগ দিয়ে নারীদের সম্মান বৃদ্ধি করা যাবেনা। বরং এর মাধ্যমে সমাজে তৈরি হবে অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলা  ,সম্পর্ক নষ্ট হবে ভাই বোনের। অনেকেই মনে করেন সম্পত্তিতে নারী পুরুষের সমান অধিকার যদি হতো নারীদের সম্মানের কারণ; তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনই  তা করতেন। সুতরাং সরকারের উচিত হবে আ্ত্মঘাতি এ সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসা।
নারী নেত্রীদের সাথে সাধারণ মহিলাদের কথার কোন মিল নেই। নারী নীতিতে তারা কেউ কেউ সন্তোষ প্রকাশ করলেও কেউ কেউ আবার ক্ষোভ ও প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতির নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সালমা আলী বলেন-******************************************************************বাবা ও ”স্বামীর সম্পত্তিতে নারীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও সমান অংীশদার নিশ্চিতকরন খুবই গুরত্বপূর্ণ। তবে নীতির মাধ্যমে সম-সুযোগ ও সম অধিকার প্রদানের চেয়ে সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূণ্ ৃবিষয়।”
আইন ও সালিস কেন্দ্রের  নির্বাহি পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন-”নারী নীতিতে উত্তরাধিকার সম্পদে নারীদের সমঅধিকারের বিষয়টি না থাকলেও উপার্জন, উত্তরাধিকার,  ঋণ,  ভুমি, ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা রয়েছে।” বর্তমান নারী নীতিতে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করলেও ৯৭ সালের নীতিটিকেই তিনি বস্তুনিষ্ঠ বলে মনে করেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন-”আমি মনে করি নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্তেও বর্তমান নীতির বহূ সম্ভাবনা রয়েছে।এটি নিয়ে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।”
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এডভোকেট এলিনা খান বলেন,” নারী নীতি প্রনয়নের কথা বলে বার বার আমাদের ঠকানো হচ্ছে।”
সরকার যদি মনে করে সমঅধিকার ও সমসুযোগের বিধান না রেখে নীতি করবে তাহলে নীতি করে লাভ কী? নারী নীতি নিয়ে তেমন কোন জোরালো  মন্তব্য না  থাকলেও অন্য  আারেকটি সংস্থা নারী ক্ষমতায়নে কাজ করছে। ”সিডিএলজি” এর নির্বাহী পরিচালক ডঃ আবু তালেব প্রণীত মিলেনিয়াম প্রোপোজাল পার্ট ওয়ান (এমপো)নামে পরিচিত সংস্থাটি সরকারের প্রত্যোকটি  বিধানিক পদে ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্ব চায়।
এমপো প্রণীত ১১ দফার মধ্যে প্রতিটি সংসদীয় আসনে ১জন পুরুষ এমপির পাশাপাশি ১জন মহিলা এমপি, একজন পুরুষ ডেপুটি স্পিকারের পাশাপাশি একজন মাহলা ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের সুপারিশ করছে। এছাড়া ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে ১জন পুুরুষের পাশাপাশি ১জন মহিলা , ইউনিয়ন ,  পৌরসভা ও উপজেলায় একজন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যানের পাশাপাশি  ১জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টির দাবী করছে। এছাড়া জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়েও ১জন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যানের পাশাপাশি ১ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রাখার পক্ষপাতি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ আইন সকলের জন্য প্রযোয্য হলেও বিবাহ ও সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন ধর্মীয় দিক থেকে তৈরি করা হয়েছে। যেমন -হিšন্দু, বৌদ্ধ, ও খৃষ্টান  ধর্মাবলম্বীদের  জন্য পৃথক আইন রয়েছে।  মুসলমানদের বিবাহ ও তালাক রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক হলেও হিন্দুদের ক্ষেত্রে  এধরণের নিয়ম নেই। এ ধর্ম অনুযায়ী নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে ইসলামে নারীদের যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে তা অন্য ধর্মে দেয়া হয়নি।
নারীদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-”তারা তোমাদের পোশাক,তোমরা তারদের পোশাক।”অন্যত্র  বলা হয়েছে-”তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সদাচারণ কর।”এছাড়া আরো বলা হয়েছে-নারীদের উপর যেমনি অধিকার রয়েছে পুরুষের , তেমনি অধিকার রয়েছে পুরুষের উপড় নারীর। ”পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে-”তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।” অন্য যায়গায় বলা হয়েছে-”ুুুুুুুুমাতার পায়ের তলে সন্তানের বেহেস্ত।”
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা । সকালে ঘুম থেকে উঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমুতে যাবার সময় পর্যন্ত কোন্ কাজ কোন্ নিয়মে করতে হবে সবকিছু ই বলে দিয়েছে ইসলাম। তেমনি সম্পত্তি বন্টনের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সুরা নিসার ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ”তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন পুরুষদের অংশ হবে দুজন মেয়ের সমান।”
ভাই কেন বেশি পায়?এর পেছনেও যুক্তি রয়েছে। মা, বাবা , ছেলে ,মেয়ে , ও স্ত্রীকে ভরণ -পোষণের  দায়িত্ব ছেলের, মেয়ের নয়। এমনকি তার যদি কোন সম্পদ নাও থাকে তবুও স্ত্রীর সম্পত্তি দিয়ে স্ত্রী বা পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারবেনা। অতএব পুরুষের যেহেতু সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব বেশি, তাই সম্পত্তি বিভাজনের ক্ষেত্রে তাকে নারীর চেয়ে বেশি দেয়া হয়েছে।
এছাড়া নারীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। এসময় নারী যে উপহার পায় তার উপর স্বামীর বা অন্য কারো কোন অধিকার থাকেনা। স্ত্রীর আয়ে স্বামীর কোন ভাগ নেই।  এমনকি বিয়ের পরও স্ত্রী যে উপার্জন করে তা তার নিজস্ব। পরিবারে খরচ করার জন্য স্বামী তাকে জোর করতে পারেনা।
মাওলানা ফজলুল হক আমিনি সহ বেশ কয়েকটি ধর্মীয় দল নারী নীতির চরম বিরোধীতা করেছেন। তিনি বলেন-”আমরা পাশ্চাত্যের ধাঁচে কোন আইন মানিনা। বাংলার মাটিতে কুরআন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।যারা কুরআনকে বিদায় করতে চান তাদেরকেই এদেশ থেকে বিদায় করা হবে। ”ইসলামী আন্দোলনের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য সৈয়দ মোঃ ফয়জুল করিম বলেন-”নারীদের সমঅধিকার দিলে সমাজ ও পরিবারেরআগুন লাগবে। নারী অধিকারের ব্যাপারে যারা চিল্লাচ্ছেন তাদের পারিবারিক বন্ধন খুবই দূর্বল।” খেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা আ ঃ রব ইউসুফি বলেন-”বর্তমান সরকার কোরান, আল্লাহ্ ও রাসুলকে চ্যালেঞ্জ করেেেছ। আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।”
মহিলা ও শিশু বিয়ক প্রতিমন্ত্রী ডক্টর শারমিন চৌধুরি বলেন”নারী তার অর্জিত সম্পত্তির পূর্ণ আধিকার পাবেন। তিনি বলেন-”নারীনীতির সাথে মুসলিম সম্পত্তি আইনের কোন বিরোধ নেই।এ নিয়ে একটি মহল হরতাল করে জনগণের মনে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। জনগণের মনের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় আপত্তিজনক ধারা দুটির ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-সম্পদ বলতে কোন উত্তরাধিকার সম্পদকে বুঝানো হয়নি। এখানে বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে নারীকে একজন নাগরিক হিসেবে সম্পদ অর্জন, স্বস্ব কর্মস্থল ও ব্যবসা-বাণিজ্যে তার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য অংশিদারিত্বের কথা বলা হয়েছে। ২৫/২ ধারায় উত্তরাধিকার বলতে নারী যে সম্পদ অর্জন করে তার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বুঝায়।”
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯/১ ধারায় বলা হয়েছে-”সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে।” তাই মহিলাদেরকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সমিচিীন নয়। এছাড়া বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংগঠন সিডিও এর নীতি সমর্থন করে । এসংগঠনটির প্রধান লক্ষ হলো: নারীর প্রতি সব ধরণের বৈষম্যের বিলোপ সাধন। তবে একথাও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কর্মকান্ডে তাদের সমর্থন পাওয়া কঠিন হবে। তাই সমস্যার সমাধানে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজনে বিরোধীতাকারীদের সাথে আলোচনায় বসে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে হবে।। লেখকঃ প্রভাষক,সাংবাদিক বসধরষ:30/08/2011 






















































































































Post a Comment

0 Comments