বাংলাদেশকে ভালেবেসে চলে এসেছেন নাওকো হারাদা ‏ ব্রাহ্মণপাড়ার অজপাড়া গায়ে জাপানী বধুর দিনকাল

বাংলাদেশকে ভালেবেসে চলে এসেছেন নাওকো হারাদা
‏ ব্রাহ্মণপাড়ার অজপাড়া গায়ে জাপানী বধুর দিনকাল

“মমিনুল ইসলাম মোল­া”
জাপানী মেয়ে বিয়ে করে জাপানিজ সিটিজেন হয়েও জাপানীবধু নিয়ে স্থায়ীভাবে দেশে চলে এসেছেন সফিকুল ইসলাম (৪৫) কুমিল­ার ব্রা‏হ্মণপাড়ার ষাটশালা গ্রাসে সফিকের বাড়ি, তার পিতার নাম মরহুম নজরুল ইসলাম (দারোগা)। 

সফিকুল ইসলামের স্ত্রীর নাম নাওকো হারাদা (২৮)। তিনি ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে আসেন। এখনও তাকে দেখার জন্য বহু দূর থেকে লোকজন আসে। তাকে দেখতে আসা লোকদের সাথে হাসিমুখে কথা বলেন হারাদা। যতটুকু সম্ভব বাংলা ভাষার তাদের অভিনন্দন জানান। নিজেই চা পরিবেশন করেন। 
সফিকুল বলে­ন- বাংলাদেশের লোকেরা বিদেশে গিয়ে বিয়ে করে সেদেশের সিটিজেন হয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে নিজের আখের গোচ্ছাতে চায়। আমি বাংলাদেশকে ভালবাসি। তাই বিয়ে করে জাপান প্রবাসী না হয়ে জাপানী বন্ধু দিয়ে স্তায়ীভাবে দেশে চলে এসেছি। নাওকো হারাদাও সাথে সাথে বলে­ন- ওয়াাসি ওয়া বাংলাদেশ দাইসকি। (আমিও বাংলাদেশকে ভালবাসি)। 
সফিকুল ইসলাম ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম ওমরগণি কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেন। তখন পিতার পরামর্শে উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপান যাওয়ার চিন্তা করেন। স্টুডেন্ড ভিসা পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করলে ভাগ্যগুনে অতি সহজেই তা পেয়ে যান। 
১৯৮৮ সালে সফিক জাপানের মাটিতে পা রাখেন। স্যাপল্প নামের একটি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হোন। এ প্রতিষ্ঠানটি জাপানের ইকেবাকর, টোকিওতে অবস্থিত। অধিকাংশ বাংলাদেশী ও প্রতিষ্ঠানে জাপানী ভাষা শিখেন। 
প্রতিষ্ঠানে ৪০০ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে বাংলাদেশীই বেশি। এছাড়াও চাইনিজ, নেপালিজ, মায়ানমারসহ অন্যান্য দেশের লোকেরা এখানে ভাষা শিখতে আসেন। সফিক মর্নিং শিফ্টে ভর্তি হোন। ক্লাশ করতে গিয়ে দেখলেন বাংলাদেশের ২০/২৫ জন তার মতই অন্বেষণে এদেশে এসেছেন।  
সফিক বলে­ন- দালালের মাদ্যমে জাপান যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই সকলেই স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যেতে চায়। এক্ষেত্রে বয়স তে হয় ১৮-৩০ এর মধ্যে এবং কমপক্ষে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে যেতে হয়। ভাষা শিক্ষার কোর্স ২ বছর। ফোন করলে দেশে ফেরত আসতে হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে প্রতি মাসের বেতন ৫০ হাজার টাকা হিসেবে ২৪ মাসের বেতন অগ্রীম দিয়ে সেখানে ভর্তি হতে হয়। প্রতিষ্ঠানের বেতন, ভর্তি ফি ও বিমান ভাড়া বাদে অন্য কোন খাতে টাকা দিতে হয় না। 
বাংলাদেশী ভাষা শিক্ষার্থীরা সেখানে প্রতিদিন ৩ ঘন্টা করে ক্লাশ করে। বাকী সময় কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে বাধা নেই। তবে পরীক্ষার খারাপ করলে সমস্যা হয়। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয় ৩টি গ্রেডে। যারা ৫০০ জাপানী শব্দ শিখেছেন তাদের গ্রেড ‘সানকিউ’ যারা ২ থেকে ৩ হাজার শব্দ শিখেছেন তারা পান ‘নিকিউ’ এবং যারা ৪-৫ হাজার শব্দ আয়ও করতে পারেন তারা হুকিউ (উচ্চতর) গ্রেডে উত্তীর্ণ হন। ভাষা শিক্ষা কোর্স শেষ হলে উচ্চতর লেখা পড়া করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কিংবা অন্যত্র চাকুরী করা যায়। 
ভাষা শিক্ষা কোর্স শেষ হওয়ার পর তিনি রেস্টুরেন্ট কাজ নিলেন। দেশের লেখাপড়া শেষ, জাপানী ভাষা শিখাও শেষ, এখন মোটামোটি বেতনে চাকুরীরও করেন এখন একজন জীবন সদী প্রয়োজন। বাবা দেশে পাত্রী দেখছেন। কিন্তু আপাতত দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই সফিকের। 
এমনই একদিন বিকেলে শ্রীলংকান এক বান্ধবীর মাধ্যমে পরিচিত হলেন। নাওকো হারাদা নামের এক বিদূষী মহিলার সঙ্গে। নাওকো ১৯৯১ সালে এইচএসসি পাশ করে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলেন। ফলে কোর্স কমপ্লিট না করেই দেশে চলে আসেন। দেশে ফেরার পর পায়ের সমস্যা কেটে গেলেও আর আমেরিকাতে যাননি। তখন পার্টটাইম জব করতেন। 
পরিচিত হওয়ার পর নাওকোর সাথে ঘনিষ্ট হতে সুদর্শন যুবক সফিকের বেশি সময় লাগেনি। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করবেন। বাবা মার পক্ষ থেকেও গ্রীণ সিগন্যাল পেলেন। তবে নাওকো হারাদার ভালবাসা পরীক্ষার জন্য বলে­ন বিয়ের পর আমরা দুকন বাংলাদেশে ফিরে যাব। নাওকো এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলেন। 
১৯৯৪ সালে সিটি অফিসে বিয়ে হয়ে গেল বাংলাদেশের কুমিল­া জেলার বি-পাড়া উপজেলার ষাটশালা গ্রামের নজরুল ইসলামে বেটা সফিকের সঙ্গে জাপানের ওসাকার কিউসি হারাদার জোট নাওকো হারাদর। বিয়েতে স্বাক্ষী থাকলেন রেস্ট্ররেন্টের মালিক এবং বন্ধু মাকি হিরোশি নাওকোর মা-বাবা এ বিয়ে মেনে নেননি। সফিককে জাপান থেকে বের করার জন্য চক্রান্ত শুরু করলেন। মেয়ে অপহরণের মামলাসহ পারিবারিক আদালতেও মামলা করলেন। কিন্তু আদালতে নাওকো যখন বলে­ন- ‘আমি সফিককে ভালেবেসে বিয়ে করেছি’ আমি তাকে তাকে ছাড়া বাঁচব না।’ তখন সব ঝামেলা চুকে গেল। ধীরে ধীরে বরফ গলতে লাগল এবং শ্বশুর-শ্বাশুড়ী সফিককে আপন করে নিলেন এবং তারা বাংলাদেশেও এসেছেন। 
নাওকো হারাদা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে আসেন। ১৯৯৯ সালে। জাপানের চাকচিক্যময় শহর ছেড়ে অজপাড়াগায়ে এলেও তার খারাপ লাগেনি। বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশ পেয়ে সকুাুাুাুাুুাতু উপযোগ করেছেন। তাি স্বামীকে জাপানের চাকুরি ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বলেন। ফলে সফিক ২০০৪ মালে স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসেন। 
সজুব মাঠ গ্রাম্য প্রকৃতি, ঢাকার ঐতিহ্য আর কক্সবাজারের মনোরম দৃশ্যে সবাই তার ভাল লাগে। তিনি বৌদ্ধধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। নিয়মিত নামাজ, রোজা করেন-জানালেন সফিক। নাওকো বাংলাদেশের সকল খাবারই পছন্দ করেন। কথায় ফাকেই বলে উঠলেন- ওয়াতাসিওয়া সুঠকি দাইস্কি। অর্থ্যাৎ তিনি শুটকি পছন্দ করেন। আর ঘৃণা করেন মিথ্যা কথা বলা এবং ঝগড়া করা। অপছন্দ করেন অলস লোকদের। তিনি ২০০৪ সালে ষাইটশালা একটি রেজি: বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। 
সফিক ও নাওকো বর্তমানে ৩ সন্তানের জনক। ছেলের নাম কাজু হারাদা, বড় মেয়ের নাম মিনা হারাদা ও ছোট মেয়ের নাম আখি হারাদা, এরা সবাই চট্টগ্রামের একটি বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। সফিক বর্তমানে সাপের খামার পরিচালনা করেন।  

Post a Comment

0 Comments