অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস মায়ের দুধঃ শিশুর উত্তর খাবার

অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবস
মায়ের দুধঃ শিশুর উত্তর খাবার

স্তন্যপায়ী প্রাণীরা তাদেও বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ায়। স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে মানুষ তাদের সন্তানদের দুধ খাওয়াচ্ছে। হযরত হাওয়া (আঃ) থেকে শুরু করে এখন পর্যন্তএ ধারা চলছে । তবে দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা যে শুধুই শিশুর জন্য উপকারী তা নয়। এটি কোন একচেটিয়া বা একপক্ষীয় ব্যাপার নয়।
ব্রেস্ট ফিডিং মা ও শিশু উভয়ের জন্য উপকারী। মূলত মা তার নিজে শান্তির জন্যই শিশুকে দু দেন।  আবার শিশুও তার খাদ্যের চাহিদা না মেটলে কান্না-কাটি করে। তাই গ্রামদেশে একটি বাক্য প্রচলিত রয়েছে “ শিশু না  কাঁদলে মাও দুধ দেয় না।”                 শিশুকে কাঁদানো মায়ের ইচ্ছা নয় তারপরও যা চান শিশু নিজে থেকে আগ্রহ প্রকাশ করুক। এতে মা ও শিশুর সুন্দর সমন্বয় ঘটে। ফলে তাদের বন্ধন দৃঢ় হয়। যেসব মায়েরা কষ্ট সহ্য করে হলেও আড়াই বছর বুকের দুধ খাওয়ান তাদের শিশুরা সার জীবন তাদের অনুগত থাকে। এটাই মূলত রক্তের টান। এক্ষেত্রে শহুরে মায়েদের তুলনায় গ্রামীণ মায়েরা সবসময় এগিয়ে থাকেন।  তাই গ্রামের ছেলে মেয়েরা মায়ের বেশি আন্তরিক। বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের দেহে অক্সিটোসিনের নিঃসরন বাড়ে। এটি জরায়ু ও এর রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করতে সহায়তা করে।  ফলে সন্তান জন্ম দেবার পর মায়ের জরায়ু থেকে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হয় না। এতে মায়ের রক্ত স্বল্পতা রোধ হয়। এটি প্রাকৃতিক জন্ম নিয়ন্ত্রক হিসেবে ও কাজ করে। অর্থাৎ মা শিশুকে নিয়মিত দুধ খাওয়ালে তিনি সহজে গর্ভাতী হন না। কারন এতে ডিম্বপাত রোধ হয়। গবেষনায় দেখা গেছে এতে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ ও ডিম্বাশয় ক্যান্সারের ঝুঁকি ৪০ শতাংশ হ্র্রাস পায়। এছাড়া জরায়ু ক্যান্সার ও হাড়ের ক্ষয় রোগের সম্ভাবনা কমে যায় এবং মা মানসিক ভাবে ও প্রফুল্ল থাকেন। 
বাচ্চা প্রসবের পর স্বাভাবিক ভাবেই মায়ের স্বাস্থহানী ঘটে। মাকে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে হলে অতিরিক্ত  ক্যালরী গ্রহণ করতে হয়। যেসব মা নিয়মিত ভাবে বাচ্চাকে বুকের দুধ দেন তারা অতিরিক্ত ক্যান্সারী গ্রহন করতে পারেন। পরিবারের ও তাদের মর্যাদা বাড়ে। কেননা ৮০০ টাকা দিয়ে একটি দুধের কৌটা কিনে শিশুকে না খাইয়ে এই ৮০০ টাকা মায়ের পেছনে খরচ করলে যদি সন্তানের দুধের চাহিদা মেটে তাহলে শিশু- মা পরিবার সবাই খুশী। তাই ব্রেষ্ট ফিডিং এর গুরুত্ব অত্যধিক। এসময় তাকে প্রতিদিন খেতে হবেঃ প্রোটিন ৬৫ গ্রাম , কার্বোহাইট্রেট ৫৫০ গ্রাম, তেল বা চর্বি ৫০ গ্রাম, লোহা ০.০৩ গ্রাম, ভিটামিন এ ১১৫০ মাঃ গ্রামঃ ভিটামিন ডি ১০ মাঃ গ্রাঃ ,ভিটামিন বি-২ ২.৫ মিঃ গ্রাম , ফলিক অ্যাসিড ৩০০ মাঃ গ্রাম,  ভিটামিন সি ৫০ মিঃ গ্রাম সহ মোট ক্যালরী প্রয়োজন ২৬০০। একথা সত্য যে অধিকাংশ প্রসূতি উপযুক্ত খাদ্য পান না কোন কোন পরিবার দারিদ্রের কারণে কোন কোন পরিবার অজ্ঞতার কারণে আবার কেউ কেউ বঞ্চিত হচ্ছেন কুসংস্করজনিত কারণে। 
আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে গর্ভবর্তী মা ও প্রসূতিদের খাবারের ব্যাপারে কিছু কুসংস্কার চালু রয়েছে। ফলে তারা পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হন। গ্রামের মায়েরা জানিয়েছেন তাদেরকে সে সময় ডিম, দুধ, কলা শাক সব্জি চাল কুমড়া, বাইন মাছ খেতে দেয়া হয়নি;  শুধু তাই নয় সন্তান বড় হয়ে গেলে প্রসবে সমস্যা হবে। তাই বেশিরি ভাগ সময় কাজ কর্ম ও হাঁটা চলার মধ্যে থাকতে হবে। শক্ত করে কাপড়ের গিট দিতে হবে। নইলে বাচ্চা উপরের দিকে উঠে যেতে পারে। প্রসবের সময় মাথা উপরের দিকে  থাকলে প্রসূতির মৃত্যুও হতে পারে। এভাবে   কুসংস্কারে আবদ্ধ  থাকায় মাও শিশু উভয়ই কষ্টের শিকার হয়। শিশুর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার আগে মায়ের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতি বছর ১২০০০ মা প্রসব  জনিত জটিলতায় মারা যান। বর্তমানে মাতৃ মৃত্যুর হার প্রতি লাখে  (জীবিত জন্মে) ২৯০ জন নব জাতকের মৃত্যুর হার প্রতি  হাজারে ৩৭ জন সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মিলেনিয়াম ডেভলাপমেন্ট গোল অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃ মৃত্যুর হার ৪ ভাগের ৩ ভাগ এবং নবজাতকের মৃত্যু হার ৩ ভাগের ২ ভাগ কমিয়ে আনতে হবে। এখনও ৮৫% প্রসব  অদক্ষ দাইয়ের হাতে হয় ৮০ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছরের কম বয়সে। ২৩% নারী ২০ বছর বয়সের আগেই গর্ভধারণ করে। ১৪ শতাংশ নারী গর্ভাবস্থায় স্বামী ও শ্বশুর পক্ষের আত্মীয়ের হাতে নির্মম শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এতে মা ও শিশুর ঝুঁকি বাড়ছে। আরেকটি গবেষনায় দেখা গেছে ২০০৯ সালে প্রতি ১ হাজার শিশু জন্মের বিপরীতে মৃত্যু ৫৭ থেকে  কমে ৩০ এ নেমেছে। অর্থাৎ প্রতি হাজার শিশু মৃত্যুও হার ২৭  । ২০১৫ এর মধ্যে তা ২১ এ নামিয়ে আনা হবে।
 অনেক মা রয়েছেন যারা নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রেখে সন্তানকে দুধ দেয়ার ব্যাপারে কার্পন্য করেন। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকায় তারা বিকল্প দুধের প্রতি মনযোগী হন। প্রকৃতপক্ষে একজন মাকে পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরে আসতে সন্তানকে দুধ দেয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রসব পরবর্তী শারিরীক অবস্থার প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় “ইনভোলিউশন”।  গর্ভাবস্থায় প্রসূতির ওজন ১০/১২ কেজি বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থা ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। নারীর ফুলে ফেঁপে উঠা জরায়ু ধীরে ধীরে  আগের অবস্থায় ফিরে আসে। প্রসব পরবর্তী শারীরিক অবস্থায় এ পরিবর্তন ঘটতে কামপক্ষে ৩ মাস সময় লাগে । শিশুকে নিয়মিত দুধ খাওয়ালে মায়ের হরমোনাল ও মানসিক ও শারিরীক পরিবর্তনের জন্য ও এটি সহায়ক। নরমাল ডেলিভারী হলে ৩ মাস, সিজারিয়ান হলে ৬ মাস কোন ব্যায়াম বা ভারী কাজ করা যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশে শিশুকে দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে সবাই সচেতন। গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা বাড়লেও অনেকেই মায়ের দুধের পাশাপাশি কৌটার দুধ খাওয়ান। তাদের ধারণা বিকল্প দুধ না খাওয়ালে সন্তানের পুষ্টির ঘাটতি পুরণ হবে না। এ ব্যাপারে ডাক্তারগন বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু দুঃখজনক হলোও সত্য ডিবির দুধ বিক্রিয়কারী প্রতিষ্ঠান সমূহ ডাক্তারদের এমনভাবে প্রভাবিত করছেন তারা বিনা প্রয়োজনে ও কৌটার দুধ প্রেস্ত্রাইভ করে থাকেন । শিশুর দুধ নিশ্চিত করতে হলে মায়ের স্বাস্থ্যের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক পরিবার মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতন নন। তারা তাদের পরিবারেরর গর্ভবতী মায়ের প্রসবের ব্যাপারে ও সচেতন নন।  প্রসবের ব্যপারটি মহিলাদের জন্য আনন্দের হলেও এক্ষেত্রে যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে । পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলে অল্প সময়ের মধ্যে প্রসূতির মৃত্যুও হতে পারে। একটি বেসরকারী সংস্থার উন্নয়নকার্মী মমতাজ গ্রাম এলাকার ঘরোয়া প্রসবের ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি এমনই একটি অভিজ্ঞতার কথা জানালেন -বাচ্চার নাভী বাঁধার জন্য একটু সুতা পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কাঁথা সেলাই করা মোটা সুতা দিয়ে নাভি বাধা হলে এ অবস্থায় রেখে দোকানে যায় বেøড কিনতে। কিন্তু দোকান বন্ধ থাকায় দাঁড়ি কাটার পুরনো বেøড দিয়েই নাভী কাটা হয়। এ ধরণের অবহেলার কারণে মা ও শিশু দুজনেরই ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ফলে গ্রামের বহু নারী প্রসব পরবর্তী জটিলতায় ভুগেন। এক গবেষনায় দেখা গেছে কর্মজীবি  মায়েদের বাচ্চা খুবই দুর্বল হয়। তারা শিক্ষিত ও স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় পরও বাচ্চাকে সঠিকভাবে লালন পালন করতে পারেন না। এ ব্যাপারটির প্রতি খেয়াল রেখেই সরকার জানুয়ারী -১১ থেকে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি  ৪ মাস থেকে  বাড়িয়ে ৬ মাস  করা হয়। ২৫ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ব্যাংকে চাকুরি নিয়েছিলেন মুসলেমা -তিনি বলেন এখনকার অফিসের পরিবেশতো সেদিনের তুলনায় অনেক উদার। পুরষ সহকারীরাও অনেক সচেতন । এখনকার কর্মজীবি মেয়েরা আমাদের তুলনায় অনেক  লাকি। তবে সকল অফিসে এখনও মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস কার্যকর হয়নি।  মহিলা পুলিশদের জানুয়ারী -১১ এর আগ পর্যন্ত ৪ মাসের ছুটি দেয়ার বিধান ছিল কিন্তু এর মধ্যে ১ মাসের ছুটিকে এলপিআর হিসেবে গণ্য কওে রেশন দেয়া হয়। বাকী  ৩ মাস বেতন বন্ধ থাকে। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত এসপি জেসমিন বেগম  বলেন –অন্ত স্বত্ত¡া এক নারীকে  যখন ভাল মন্দ খেতে দেয়া উচিত তখন মহিলা পুলিশের রেশন বন্ধ রাখার বিষয়টি সত্যিই আনামবিক। 
বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মীরা ও তাদের শিশুদের যথাযথ ভাবে দুধ খাওয়াতে পারেন না। তাদেরকে এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনায় ২৩ , ২৪, ২৫ অনুচ্ছেদে শ্রমিকের মানবাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সবকর্মী বা শ্রমিকের সমমজুরি, বিশ্রাম, অবসর, যুক্তিযুক্ত কর্যঘন্টাসহ শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার্থে সব অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি  সংস্থায় কর্মরত সুলতানা  মরিয়ম বলেন-ছয় মাস ছুটি পাওয়া গেলে ভাল কিন্তু অফিসে শিশুর পরিচর্যাকেন্দ্র তৈরি বাধ্যতামূলক না করলে খুব বেশি লাভ হবে না। ব্যাংক কর্মকর্তা শাহ জাহান কবির বলেন অফিসে আনার  ব্যবস্থা না থাকায় বাচ্চাটাকে নিয়ে সব সময় নিরাপাত্তাহীনতায় ভূগি তাই প্রতিটি অফিসে দিবা যতœকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা উচিত। আজকের সোনামনিটি আগামী দিনের কর্ণধার, তাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমার -আপনার সকলের। শিশুদের লালান  পালন ও বড়  করে তোলায় দায়িত্ব শুধুমাত্র মায়েরদের উপর চাপিয়ে দিলে চলবেনা। এ জন্য স্বামী, সংসর,া সমাজ সবাইকে ভাবতে হবে। শিশু  যাতে তার চাহিদামত বুকের দুধসহ অন্যান্য খাবার খেতে পারে,  ভাল বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পারে , সে ব্যবস্থা আমাদেরকেই করতে হবে। অন্যযায় আমাদেরকে পস্তাতে হবে।  

Post a Comment

0 Comments