প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী কিশোরী শান্তি-সুনীতির কথা


প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী কিশোরী শান্তি-সুনীতির কথা

মমিনুল ইসলাম মোল্লা


১৯৩১ সালে ‘ভারতীয় বিপ-বীরা অনুশীলন সমিতি’র সিদ্ধান্ত হয় কুমিল্লার তৎকালীন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি: ষ্টিভেন্সকে হত্যা করা হবে। এগুরু দায়িত্ব নিয়ে অতীন্দ্র মোহন রায় মাঠে নামেন। ওই সময় মেয়েদের এক সাতার প্রতিযোগিতা হয়েছিল কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা স্কুল পুকুরে। তৎকালীন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি: ষ্টিভেন্স সাতার প্রতিযোগিতায় উপস্থিত ছিলেন।  শান্তি, সুনীতির সাতারে পারদর্শিতা দেখে তিনি তাদেরকে সাতার অনুশীলনে আরো উৎসাহিত করেছিলেন। অতীন্দ্র মোহন রায়ও সাতার প্রতিযোগিতায় দর্শক হিসাবে উপভোগ করেন। অতীন্দ্র মোহন রায় ষ্টীভেন্স হত্যা পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে ওই শান্তি, সুনীতির পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন। প্রাইভেট পড়াচ্ছলে দুই কিশোরীকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে দিক্ষীত করে বিপ্লবী কর্মী তৈরী করে তুলেন। 
১৯৩১ সনের ১৪ই ডিসেম্বর পরিকল্পনা অনুযায়ী শান্তি ও সুনীতিকে ইন্ডিয়ান পোশাক পরিয়ে সাজিয়ে ঘোড়ার গাড়ীতে করে তাদের পাঠানো হয়। সকাল ৮টায় ঘোড়ার গাড়ী এসে থামল জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ষ্টিভেন্স’র বাংলো’র গেইটের সামনে, যা বর্তমান কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের বাংলো হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি: ষ্ট্রিভেন্স যেহেতু তাদের সাতারে মুগ্ধ হয়ে অনুশীলনে উৎসাহিত করেছিলেন, সেহেতু পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে তারা এসুযোগটি কাজে লাগাতে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি: ষ্টিভেন্সকে সম্ভোধন করে একটি আবেদনপত্র লিখেছিলেন। ওই আবেদন পত্রে কুমিল্লা ধর্মসাগরে সাতার প্রতিযোগিতার অনুমতি চাওয়া হয়। তিনি রিভলবিং চেয়ারে বসা অবস্থায় দরখাস্তটি চোখের সামনে তুলে ধরেন। দরখাস্তের আড়ালে শান্তি-সুনীতি তাদের জীবন বাজি রেখে দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উপযুক্ত সময়টাকে কাজে লাগান। মূহুর্তের মধ্যে দুটি রিভলভার গর্জে উঠার সাথে সাথে পুরো বাংলো এলাকা আতঙ্কিত হয়ে উঠে। মি: ষ্টিভেন্সও চিৎকার করে বলে উঠেন ‘আমার রিভলবারটি কোথায় ?’ হাপুড়ে দোতলায় উঠার চেষ্টা করে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ততক্ষণে তার প্রাণ প্রদীপ নিভে গেলেও শান্তি-সুনীতি ধরা পড়ে  তার রক্ষীদের হাতে। দেহরক্ষী ও প্রহরীরা দু’কিশোরীর উপর চালায় শারীরিক নির্যাতন। দোতলা থেকে ষ্টিভেন্স’র স্ত্রী ইংরেজ লেডী স্বামীর এ পরিনতি দেখেও প্রহরীদেরকে বলেন ”এদের গায়ে হাত দিওনা না তাদের আইনের হাতে সোপর্দ কর, তাদের বিচার আইনানুগ ভাবেই হবে।” আইনানুগ ভাবে ষ্টিভেন্স হত্যা মামলার দু’আসামী শান্তি-সুনীতি’র বিচারকার্য চলে কুমিল্লা জজকোর্টে। এদেশের  মানুষের বিপ্লবী চেতনায় আতঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার  আসামীদের নিজ শহরে মামলাটির বিচার কার্য পরিচালনা করা নিরাপদ নয় ভেবে শান্তি-সুনীতিকে আলীপুর জেলে স্থানান্তর করা হয় এবং আলীপুর জেলা জজ আদালতেই বিচার কার্য সম্পাদন করা হয়। আলীপুরের তমলুকের জেলখানায় শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরানীকে রাখা হয়েছিল। এটি ছিল ভারতের প্রথম মহিলা জেলখানা। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এটি চালু ছিল। এ জেলখানায় তাদের সাথে অন্তরীণ ছিলেন চার্লস টেগার্টের ওপর বোমা ছোড়ার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত কমলা দাশ গুপ্ত, আইন অমান্য আন্দোলনকারী মাতঙ্গীনি হাজরা। সে জেলখানায় একটি মাত্র রান্না ঘর ছিল।  ভারতের সব রাজ্যের কয়েদীদের জন্য একই খাবার তৈরি হতো। মলমূত্র ত্যাগের জন্য পৃথক কোন শৌচাগার ছিল না। খোলা নর্দমায় সবাই মল ত্যাগ করতো। মারাত্মক মশার আক্রমণে সবাই অতিষ্ঠ ছিল। বিপ্লবী কমলা দাশ এখানে এসে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এটি বর্তমানে  আইআইটি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিচারকার্য সম্পাদনের পর বিচারক ওই দু’কিশোরীর বয়স বিবেচনা করে  মৃত্যু দন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। শান্তি-সুনীতির এই কারা দন্ড কার্যকর করা হয় আন্দামান কারাগারে। 
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর থেকে ব্রিটিস সরকার সিদ্ধান্ত নেয় মৃত্যুদন্ড থেকে বেঁচে যাওয়া বিপ্লবীদের স্থান দেয়া হবে আন্দামান জেলখানায়। এটা ছিল দমননীতির প্রধান হাতিয়ার। এককথায় বলা যায় মৃত্যু ফাঁদ। সেখান থেকে কেউ জীবিত ফিরে আসতে পারতো না। যাদের ফাঁসির আদেশ হতো তাদের দড়ির মাধ্যমে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়ে লাশ ফেলে দেয়া হতো সাগরে। আর এ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ কলকাতা থেকে ১২৫৫ কিলোমিটার এবং মাদ্রাজ থেকে ১১৫১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৮৪টি দ্বীপ নিয়ে এটি গঠিত। ১৭৮৯ সালে দ্বীপটি ব্রিটিসদের দখলে আসে। ১০ মার্চ ১৮৫৮ সালজেবি ওয়াকারের নেতৃত্বে ২০০ জন বিদ্রোহীকে নিয়ে একটি জাহাজ আসে। সেই থেকে শুরু, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি চালু ছিল। ১৮৯৬ সালে কয়েদিদের দিয়েই জেলখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৯০৬ সালে ৬৯৮ টি সেল বিশিষ্ট একটি কারাগার তৈরি হয়। এটি আন্দামান সেলুলার জেল নামে পরিচিত। প্রতিটি সেলের দৈর্ঘ ছিল ১৩ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ৬ ফুট। এক্ষুদ্র যায়গায়ই দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন শান্তি-সুনীতি। শুধু এদুজন বীরকন্যাই নন ১৯৩৭ সালের হিসেব অনুযায়ী এজেলে মোট ৩৮৫ বন্দীর মধ্যে বাংলার বন্দীর সংখ্যাই ছিল ৩৩৯ জন। এছাড়া এখানে জেল খেটেছেন বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, হেম চন্দ্র দাশ, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় , সাভাকর ভ্রাতৃদ্বয়, গনেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, উল্লাস কর দত্ত, ও মহারাজ ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ। সারা বছর লেগে থাকা বর্ষা কর্দমাক্ত পথ, বড় বড় পাহাড়ি জোকঁ, পাহাড় কাটা , জঙ্গল পরিষ্কার, ও খাদ্য কষ্ট নিয়ে বিদ্রোহীরা থকতে বাধ্য হতো। এসব যন্ত্রণার আবসানের জন্য বিপ্লবীরা অনশন করতো। এভাবে অনশন করতে গিয়ে ১৯৩৩ সালে মারা যান মহাবীর সিংহ, মোহন কিশোর ,ও মোহিত মিত্র। বর্তমানে কারাগারটি স্মৃতি যাদুঘরে পরিণত হয়েছে। 
কারাগারে সুনীতি ভট্টাচার্য দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন (ক্যান্সারে আক্রান্ত)। ১৯৪৭ সনের ভারত বিভাগের পর এই দুই রাজবন্দী মুক্তি পান। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পর সুনীতি মারা যান। তাকে তার নিজ বাড়ি দেবিদ্বার উপজেলার কাকসার গ্রামে দাহ করা হয়। ১৯৫২ সালে সুনীতির পিতা মাতা ভারতে চলে যান। শান্তির পরিবার ও ভারতে চলে যান। বিপ-বীর শান্তি এখনো বেঁচে আছেন। তার পিতা কুমিল্লা ভিক্টরীয়া সরকারী কলেজের  অধ্যাপক ছিলেন। তারা থাকতেন তালপুকুরপাড়, এবং সুনীতির পরিবার থাকতেন কুমিল্লার ডিগাম্বরীতলা। শান্তি- সুনীতির স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সরকার এপর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেয়নি। অথচ অত্যাচারী বাকল্যান্ড স্টিভেন্স এর স্মরণে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে। এস্মৃতিসৌধে লেখা রয়েছে-“ওহ সবসড়ৎু ড়ভ ঈযধৎষবং এবভৎু ইঁপশষধহফ ঝঃবাবহং পড়ষষবপঃড়ৎ ড়ভ ঃরঢ়ঢ়বৎধ , ধংংধংংরহধঃবফ রহ পড়সরষষধ ড়হ ঃযব ১৪ঃয উবপবসনবৎ ১৯৩১ বৎবপঃবফ নু ঃযড়ংব যিড় ংবৎাবফ ঁহফবৎ যরস এদুজন বিপ্লবী যে স্কুলে লেখাপড়া করতো সেখানকার অনেক মেয়েও জানেনা কে শান্তি ঘোষ? কে সুনীতি চৌধুরানী? সুনীতির বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারের গুনাইগরের কাকসারে (মাশিকাড়া)। তার পিতার নাম রজনীকান্ত বর্মণ । তিনি কুমিল্লা জর্জ কোর্টের মোক্তার ছিলেন। তার একমাত্র কন্যা সুনীতি লেখাপড়া করতো কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা স্কুলে। শান্তি ও সুনীতি ১৯৩১ সালে ব্রিিটশ ম্যাজিষ্ট্রেটকে হত্যা করার দায়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত কুমিল্লার বিপ্লবীদের মধ্যে অতীন্দ্র মোহন রায়, ইয়াকুব আলী, আশোতোষ সিংহ উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে অনুশীলন, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, ও ছাত্রী সংঘ অন্যতম। ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে পেছনের দিকে গেলে আমরা দেখতে পাই ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে নারীরা প্রতোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। নারী বিপ্লবীদের পথিকৃত ছিলেন-স্বর্ণকুমারি দেবী, সরলা দেবী, আশালতা সেন, সরোজিনি নাইডো, ননী বালা ও দুকড়ি বালা প্রমুখ। তাদের দেখানো পথ ধরে হেঁটে গেছেন ইন্দুমতি দেবী, লীলা রায়, সাবিত্রি দেবী প্রমুখ। আমরা অনেকেই জানিনা ভারতবর্ষের প্রথম কিশোরী সশস্ত্র যোদ্ধা কুমিল্লার  শান্তি-সুনীতির কথা, তাদের বিপ্লবী মনোভাবের কথা, দেশপ্রেমের কথা, তাদের শেষ পরিনতির কথা। তাদের সম্পর্কে জানতে হলে ব্যাপকভাবে গবেষণা প্রয়োজন । তাদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের জানা প্রয়োজন।

লেখকঃ  প্রভাষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য ক্যাম্পেনার।








Post a Comment

0 Comments