সোনামনিদের ভর্তিযুদ্ধ ,অভিভাবকদের ভাবনা ও কিছু কথা
মমিনুল ইসলাম মোল্লাসন্তানের বয়স ২ বছর হলেই শহরের অভিভাবকদের চিন্তা শুরু হয়ে যায়। কোথায় পড়াবেন সোনামনিটিকে? শহরের অভিভাবকগণ আধো আধো কথায় বাবা , মা বলা শুরু করলেই সন্তানের হাতে ধরিয়ে দেন ”এ”তে আপেল, ”বি”তে বল জাতীয় ওয়ার্ড শেখার বই। যে বয়সে মনের সুখে আঁকা-আঁকি খেলার কথা সে বয়সেই তাকে চার কোণাকার বাক্স আঁকতে বলা হয়।
আর একটু বড় হলে সকালে গৃহশিক্ষক , বিকেলে কোচিং এবং রাতে গৃহকর্তা নিজেই বসেন মেয়েকে নিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই –ভাল স্কুলে ভর্তি করতে হবে এভাবে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকতে পারলেই ভাল স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে ;নইলে নয়। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। গত বছর শিক্ষাবিদগন চিন্তা করলেন এভাবে কোমলমতি শিশুদের ইদুর দৌড়ে নামানো ঠিক হচ্ছে কী? ভেবে চিন্তে সমাধানে পৌঁছলেন , লটারি পদ্ধতিতেই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হবে। সরকারি স্কুলগুলো এ নিয়ম মেনে চলছে কিছু কিছু বেসরকারি স্কুল ও লটারি পদ্ধতি চালু করেছে। সবাই তাদের ছেলে মেয়েদেরকে ভাল স্কুলে ভর্তি করতে চান। ভাল স্কুল বলতে তারা বুঝেন যে স্কুলের গড়পরতা রেজাল্ট ভাল। অর্থাৎ যে স্কুলে এ প্লাস পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। এসব স্কুলে মন্ত্রী, এমপি ,শিল্পপতি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার , সচিব , জেনারেল, ব্যারিস্টার, প্রভৃতি হাই ফাই ফ্যামিলির শিশুরা পড়াশুনা করে। তাদের ছেলে মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে তারা অনেকটা জাতে উঠে যাবে। এছাড়া অভিভাবক হিসেবেও তাদের স্ট্যটাস বেড়ে যাবে ; এমনটি ধারণা করেন অনেক অভিভাবক। আসলে এটি ভুল ধারণা। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়-যেসব বাচ্চা গাড়ি চড়ে স্কুলে আসে তারা পায়ে হেঁেটে আসা কিংবা রিক্সায় চড়ে আসা বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করে না। সহপাঠী হলেও তারা এক সাথে মেলা মেশা করেনা। মূলত ছাত্রের গূণেই স্কুল ভাল হয়। নামকরা স্কুলগুলো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বেছে বেছে জিনিয়াসদের ভর্তি করায়। তাই তারা ভাল রেজাল্ট করে। এছাড়া এসব বিদ্যালয়ে মাত্রাতিরিক্ত হোমওয়ার্ক দিয়ে দেয়।ফলে বাসায় গৃহশিক্ষক কিংবা কোচিং সেন্টারের সাহায্য নিয়ে এগুলো তৈরি করতে হয়।
এবছরও সরকারি স্কুলগুলোতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে না। ২য় থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই কওে ভর্তি করা হবে। রাজধানী ঢাকার সরকারি ২৪ টি স্কুলকে অভিাবকগন ভাল স্কুল বলে দাবি করেন । এগুলোকে ৩ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। ক শ্রেণীতে রয়েছেঃগভঃল্যবরেটরি হাই স্কুল, মিরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নবানপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নিউ ল্যাবরেটরি গার্লস হাইস্কুল, াসিলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়খশ্রেণিতে রয়েছেঃগভঃমুসলিম হাইস্কুল, বাংলাবাজার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, নারিন্দা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়,শেরেবাংলানগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাইস্কুল,ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ওধানমন্ডী কমরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।গ গ্রæপে রয়েছেঃতেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ডাকা কলেজিয়েট হাই স্কুল, গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ধানমন্ডী বয়েজ হাইস্কুল, আারমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়,শেওে বাংলানগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ও টিকাটুলি কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায় Ñরাজধানিতে ২৪টি সরকারি স্কুল, ৩শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪ শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২শ ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, ওকিন্ডারগার্টেনসহ সহ¯্রাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।এর মধ্যে আধুনিক পাঠদান পদ্ধতি অনুসরণ কওে এমন স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৩০-৩৫টি। ২০১০ সালে ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ ১৪৪০ টি আসনের বিপরীতে ফর্ম বিক্রি করে ২২ হাজার। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে আসন রয়েছে ৪৪০টি , গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল আসন রয়েছে ২৪০টি,গত বছর প্রতি আসনের বিপরীতে ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রী ছিল ১৪ জন।
২০০৯ সালে রাজধানীর ২৪টি সরকারি স্কুলের ভর্তিচ্ছুরা ভর্তি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। এসব স্কুলে ৮হাজার ৪০০ আসনের বিপরীতে প্রতিদ্ব›িদ্ধতা করে ৫৭ হাজার ৮১৬ জন শিক্ষার্থী। গড়ে ৭ জন ছাত্রের মধ্যে একজন ভর্তির সুযোগ পায়। ২০১০ সাল থেকে ঢাকার সরকারি স্কুলগুলোতে লটারি পদ্ধতি চালু করা হয়। এর আগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হতো । ভর্তি পরীকক্ষায় অনেক বিদ্যালয়ে বয়সের তুলনায় অনেক কঠিন প্রশ্ন করা হয়। এর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে শিশুরা প্রচন্ড চাপের মুখে পড়ে।ফলে তারা পরীক্ষা ভীতিতে ভ’গে। এছাড়া অনেকে ৪র্থ শেণিতে লেখাপড়া করেও ভাল স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে। ফলে কেউ ভর্তি হচ্ছে ৭বছরে আবার কেউ ভর্তি হচ্ছে ৯ বছরে। এতে বয়সের সমতা হচ্ছে না। ২০১০ সালে শুধুমাত্র রাজধানি নয় সারাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিপ্তরের (মাউশি) আওতাধিন ৩১৭টি সরকারি হাইস্কুলে যেখানে প্রথম শ্রেণি রয়েছে) সেগুলোতে লটারির মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় । এ পদ্ধতিতে জন্ম নিবনধন সনদ দেখে প্রথম শ্রেণিতে থেকে ৭ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রাথমিক বাছাই ফর্ম দেয়া হয়। এর পর প্রকাশ্যে লটারি করে নির্বাচন করা হয়। কোন কোন প্রতিষ্ঠান লটারি করার আগে মৌখিক বা সহজ সাব্ষাৎকার নিচ্ছে। লটারি পদ্ধতিতে অভিভাবকগণ খুশি। তবে এর স্স্বচ্ছতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। স্বচ্ছতা না থাকলে ভর্তিচ্ছুদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। এতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশংকাও রয়েছে। স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য অবশ্যই অভিভাবকদেও সামনে প্রকাশ্যে লটারি করা উচিত। একজন অভিভাবক বল্লেন-যেহেতু পরীক্ষা হচ্ছে না এবং লটারির ব্যবস্থাটিও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরিণ তাই উপযুক্ত নজরদারি না থাকলে হতে থাকবে স্বজনপ্রিতি। শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুহাম্মদ জফর ইকবাল বলেন-ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি বা শিশুদেও জন্য ক্ষতিকর একটি প্রক্রিয়া ছিল।লটারির মাধ্যমে শিশুওদর ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত ভাল হয়েছে।
একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বলেন-সে স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় যে সব প্রশ্ন আসে সেগুলো চতুর্থ থেকে ৬ষ্ঠশ্রেণিতে পড়ার কথা। ৬ষ্ঠ শ্রেনির পড়া যদি দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের পড়ানো হয় তাদের ব্রেনে চাপ পড়ে । তারা মানসিক সমস্যায় ভুগবে। এছাড়া ভর্তির পর ক্লাশের পড়ার চাপও বেশি। এত বেশি চাপ র্শৃঙ্খল ও বিধি নিষেধ তাদের স্বাধীন সত্তাকে বিকিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় অভিভাবকগন একধরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন। বাবা মায়ের টেনশন ছেলে-মেয়েদেরর আক্রান্ত করছে। আগে ভাল স্কুলগুলোতে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হতো । এতে একজন ছাত্র-ছাত্রীর মেধা যাচাইয়ের সুযোগ ছিল। এখন লটারির কারণে সবাই ভাগ্য নির্ভর হয়ে যাওয়ায় মেধা কমে যেতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরি বলেন-স্কুলে যাওয়ার পর পর শিশুদের প্রথমে বিভিন্নরকম খেলাধুলা এবং নানারকম আনন্দদায়ক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বর্ণ পরিচয় শেখার কথা তা না হয়ে তাদেও ভর্তি পরীক্ষা নামক একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো কিছু না বুঝে এটা তাদের জন্য ক্ষতিকর ছিল। প্রকৃতপক্ষে ভাল স্কুলের জন্য ঘুরাঘুরি না করে বাসার পাশের স্কুলে ভর্তি করানো ভাল। ছেলে-মেয়েদেরকে হোম টিউটর-প্রাইভেট-কোচিং এ না পাঠিয়ে নিজে সময় দিলে ছাত্রদেও গভীর সনযোগ থাকলে ,এবং মা বাবা সঠিকভাবে তদারকি করলে করলে ছেলেমেয়েরা অবশ্যই ভাল করবে। এছাড়া সচেতন অভিভাবগন সঠিক পরামর্শ দিয়ে যে কোন বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা পাল্টে আধুনিক ও উন্নতমানের স্কুল গড়ে তুলতে সহযোগীতা করতে পারেন। আর এভাবে শুধু মাত্র ঢাকা শহর নয় সারা দেশেই মানসম্পন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এসব বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা জাতিকে ভবিষ্যতে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারবে। লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, প্রভাষক ,সাংবাদিক, ও কলামিস্ট,কুমিল্লা।

0 Comments