গর্ভবতী মা ও শিশু
ইটালীর রাষ্ট্রনায়ক বেনিটো মুসোলিনী বলেছেন, ডধৎ রং ঃড় ধ সধহ যিধঃ সধঃবৎহরঃু রং ঃড় ধ ড়িসধহ. সত্যিই তাই। পুরুষের বীরত্ব যেমন যুদ্ধের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তেমনি নারীদের নারীত্ব স্বার্থক হয় মাতৃত্বে। আজকের মেয়ে আগামী দিনের মা। তাই যারা নতুন করে মা হতে যাচ্ছে। তাদের মাতৃত্ব সংক্রান্ত ধারনা ক্লিয়ারভাবে থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুরী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ও নতুন মাতার সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে এবং সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে মানব শিশু জন্ম লাভ করে ৮/৯ বৎসর বয়সেই এই শিশুটির দৈহিক পরিবর্তন শুরু হয়; কন্যা শিশুটি সময়ের বিবর্তনে পরিনত হয় কুমারিতে। এক সময় লাল শাড়ী পরে লম্বা ঘোমটা দিয়ে চলে যায় নতুন ঠিকানায়। সেখানে মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ থাকে না। শুধুমাত্র একজনকেই বলতে পারে মনের কথা কম বয়সী মেয়েরা এ সময় খুবই আন-ইজি ফিল করে; কেননা মাতৃত্ব সম্পর্কে তার পুরোপুরি ধারনা থাকে না। এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতেও পারে না, ব্যাথায় বুক ফাটলেও মুখ ফুটে না।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৮ বৎসর বয়সের আগে মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ। কেননা; এর আগে মেয়েরা শারিরীক ও মানসিক দিক দিয়ে সন্তান ধারনের উপযুক্ত হয় না। এর আগে সন্তান গর্ভে আসলে সন্তান নিলেও অনেক সময় সিজারের প্রয়োজন হয়।
আমাদের সাধারনত বলা হয় একজন মা ১০ মাস ১০ দিন একজন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে না। কিন্তু ডাক্তারী হিসেব মতে এ সময়কাল ২৮০ দিন বা ৪০ সপ্তাহ বা ৯ মাস ১০ দিন। গর্ভে ভ্র“ন নিষিক্ত হবার পর সন্তানটিচ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে।
‘দি নিউ প্র্যাগনেন্সী এন্ড চাইল্ড বার্থ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, নর-নারীর দৈহিক সঙ্গমের পর ভ্যাজিনাতে পুরুষের লক্ষ লক্ষ স্পার্ম এর সংকলন ঘটে। এদের একটি মাত্র স্পার্ম ফেলোপিয়ান টিউবের পথ ধরে এগিয়ে আসে এবং অসংখ্য ডিম্বানুর মধ্যে একটি ভাগ্যবসান বা ভাগ্যবর্তী ডিম্বানুকে নিষিক্ত করে। নিষিক্ত হাবার পর এই রক্তপিন্ডটি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথম মাসের শেষ দিকে এটি ওমর এ গিয়ে পৌঁছে। এ সময় প্রসূতির রুচির পরিবর্তন হয়।
পঞ্চম থেকে অষ্টম মাসের মধ্যে প্রসূতির ব্রেস্ট দৃশ্যমানভাবে বৃদ্ধি পারে, “ভ্যাজিনার রং পাল্টে যেতে পারে এবং শরীর দুর্বল লাগতে পারে। চতুর্থ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভবর্তী মা একবার ডাক্তারের কাছে যাবেন এবং এ সময়ে আরেকবার যাবেন।
এ সময় শিশুর চোখ ও কান গঠিত হয়ে থাকে। তার মুখ মানব আকৃতি নেয় এবং শিশুটি ২.৫ সেন্টিমিটার বা এক ইঞ্চি লম্বা হয়। দ্বাদশ সপ্তাহে মা আবারো ডাক্তারের কাছে যাবেন কারন তখন তিনি আগের তুলনায় বেশী অস্বস্থীবোধ করতে পারেন। এ সময় শিশু একটি বেশী নড়াচড়া করে থাকে।
ত্রয়োদশ-ষোড়শ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে একবার চেকআপ করানো প্রয়োজন। এ সময় ওমর বৃদ্ধি পেতে থাকে তলপেটের মধ্যাংশে একটি কালো দাগ দেখা যায় এবং ব্রেস্ট এর স্ফীতি ও নিপলের চারদিকটা কালো হয়ে যায়।
সপ্তাদশ থেকে অষ্টাবিংশ সপ্তাহ পর্যন্ত দু’বার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এ সময় শিশু পেটে লথি মারে, হাত মুঠো করে ও আঙ্গুল চোষে। শিশুর নড়াচড়া বাইরে থেকেও টের পাওয়া যায়। ৮ম মাসে দু’বার এবং পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহে একবার গর্ভবর্তীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ ফ্যামিলিতেই গর্ভবর্তী মাতাকে নিয়মিতভাদবে ডাক্তারের কাছে নেয়া হয় না। ফলেণ তারা নানবিধ সমস্যা সম্মুখীন হয়। নিজের অসুবিধার কথা অন্য কাউকেতো বলেনেই না এমনকি স্বামী বেচারাকেও জানতে দেন না। ফলে প্রসব জটিল হয়ে থাকে।
উন্নত বিশ্বে ১৫ বৎসর থেকে ৪৯ বৎসর বয়স পর্যন্ত নারীরা নিয়মিত তাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখে। ফলে তারা প্রসব সংক্রান্ত কোন সমস্যা ফিল করেন না। কিন্তু আমাদের দেশে শহরাঞ্চলে এ প্রবণতা কিছুটা লক্ষ করা গেলেও গ্রামাঞ্চলে নেই বলেও চলে। যতক্ষণ স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন রোগীকে নিয়েও জনসাধারণ মাথা ঘামান না।
ডি.এইচ.এস হু এবং ইউনিসেফ (১৯৯০-৯৯) এক জরিপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী যে সব মহিলা অন্তত ১ বার দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা লাভ করেছে শতকরা হার হচ্ছে নিম্নরূপ ঃ
ক্রমিক নং দেশের নাম সংখ্যা ক্রমিক নং দেশের নাম সংখ্যা
১ মাছ ২৩ ৬ কম্বোডিয়া ৩৪
২ নেপাল ২৪ ৭ ইয়ামেন ৩৪
৩ মালি ২৫ ৮ ভারত ৪৯
৪ বাংলাদেশ ২৬ ৯ মরকেকা ৪২
৫ পাকিস্তান ২৬ ১০ তাঞ্জিনিয়া ৫০
প্রেগনেন্ট হওয়ার পূর্বে একজন মহিলার দৈনিক ২২০০ ক্যালরী খাদ্যের প্রয়োজন। গর্ভবর্তী হওয়ার পর তা ২৫০০ এবং প্রসবোত্তরকালে প্রয়োজন ২৯০০ ক্যালরী। গর্ভবর্তী একজন মহিলা প্রতিদিন ৫০০ গ্রাম শর্করা (ভাতা/আটা/আলু), আমিষ (মাছ/মাংস/ ডাল)Ñ ৫৫ গ্রাম, ফ্যাট (৩ল/ঘি/মাখন) ৭০ গ্রাম সবুজ শাক-সব্জি ১২৫ গ্রাম, অন্যান্য সব্জি ১৫০ গ্রাম এবং ফলমূল ৬০ গ্রাম খেতে পারেন। তাহলে কাস্তিখত পরিমান খাদ্যেপাদান পাওয়া যাবে।
আমাদের দেশে এসব মহিলাদেরকে জোড় কলা খেতে দেয়া হয় না। জময সন্তান হওয়ার ভয়ে চাল কুমড়া খেলে দেয়া হয় না সন্তানের গায়ে চালকুমড়ার মত লোম দেখা দেবার ভয়ে, বাইন মাছ খেলে নাকি সন্তান পেটের ভেতর বাইন মাছের মত নড়াচড়া করবে। তাছাড়া অধিক খেতে দেয়া হয় না; কারণ বেশী খেলে পেটের সন্তান পরিপুষ্ট হবে ফলে প্রসবের সময় কষ্ট পাবে। আসলে এ সবই ভুল ধারনা। এদের পেছনে কোন যুক্তি নেই।
বিভিন্ন জরিপে দেখা দেছে যে, দরিদ্র এবং পুষ্টিহীন মায়েরা যে সন্তান জন্ম দেয় তাদের ওজন কম হয় এবং বুদ্ধির বিকাশ ব্যাহত হয়। অপুষ্ট শিশু অতি সহজেই রোগাক্রান্ত হয়। মায়ের স্বাস্থ্য যদি ভাল থাকে তবে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ না করেও সঠিক ওজনের শিশু জন্ম দেয়া সম্ভব।
কিন্তু মা যদি গর্ভবতী থাকাকালীন সময়ে যথেষ্ট স্বাস্থ্য না থাকেন অথবা নিজের বাড়ন্ত বয়সের দরুন নি জের বাড়তি চাহিদা পূরণে অক্ষম থাকেন। অথবা গর্ভাবস্থায় উপযুক্ত খাদ্যোপাচ্ছেন না পেলে তিনি শিশুকে যথাযথ পরিমাণ পুষ্টি দিতে পারেন না। ফলে তার উদরস্থ শিশুটি হয় কম ওজনের অপরিনত ও অপরিপূরক, মস্তিষ্ক নিয়ে সে জন্ম গ্রহণ করে।
আমাদের দেশের শতকরা ৯০% ডেলিভারী বাড়িতেই হয়ে থাকে। মূলত বাড়ীতে ডেলিভারী হওয়া খারাপ নয়। তবে; অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে প্রসবের কাজ করা খুবই খারাপ। এতে মায়ের জীবনের উপর হুমকী আসতে পারে। মাতা ও শিশু দু’জনের চোখ থেকেই পৃথিবীর আলো মুছে যেতে পারে। তাই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে শিক্ষিত দাই দিয়ে প্রসব করানো যেতে পারে।
তবে প্রসবপূর্বকালে কয়েকটি সমস্যা দেখা দিলে কখনো বাড়ীতে রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। এগুলো হচ্ছে ১। গর্ভাবস্থার শেষ দিকে পা ফুলে যাওয়া ২। এই সময়ে পেটের উপরিভাগে অত্যন্ত ব্যাথা হওয়া ও বমি বমিভাব হওয়া ৩। মাথার যন্ত্রনা হওয়া ৪। চোখে ঝাপসা দেখা ৫। ভ্যাজিনা পথে পানি বা রক্তক্ষণ হওয়া ইত্যাদি। এসব উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে কালবিলম্ব না করে মাতৃসদনে নিয়ে যাওয়া উচিত।
প্রসবোত্তরকালে মায়ে এবং শিশুর পরিচর্যা এবং খাদ্যের উপর বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। ৩-৪ মাস পর্যন্ত ৩ ঘন্টা পর পর অর্থ্যাৎ সকাল ৬টা, দুপুর ১২টা, বিকাল ৩ টা, সন্ধ্যা ৬ টাকা, রাত্রি ৯টা এবং মধ্য রাত্রিতে একবার খাওয়াতে পারেন। এ সময় সুজি, পাকা কলা, আমের রস, ও ডিম দেয়া যেতে পারে।
আমরা অনেকেই গৃহপালিত জন্তু গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদি পালন করি। এ প্রাণীগুলো যখন গর্ভবতী হয় তখন এদের বিশেষ যত্ম নেয়া হয়। সেবা-শুশ্র“ষা ও খাওয়া-দাওয়া করানোর জন্য আলাদা লোক রাখা হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের মায়েরা যখন বিশেষত্বতো দূরের অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদেরকে এ রীতি পাল্টাতে হবে। গর্ভাবতী মা ও শিশুর যত্ম নিতে হবে।

0 Comments