অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীদের অবদান কতটুকু?

অর্থনীতিতে গ্রামীণ নারীদের অবদান কতটুকু?


মমিনুল ইসলাম মোল্লা

 ১৫ অক্টোবর বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস। ২০০৭ সাল থেকে এ দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়ে আসছে। এক সময় গ্রাম্য নারীকে বলা হতো অবলা বা অসহায়। এখন দিন পাল্টে গেছে। নারীরাও এখন কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দিন বদলের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের নারীরাও কঠিন পথ অতিক্রম করে সাফল্যের শীর্ষ শিখড়ে আরোহণ করছে। এখন সে শুধু স্বামী সন্তান-আর ঘরকন্যার কাজেই নিয়োজিত থাকছেনা ,  দেশের অর্থনীতিকেও সচল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে তারা এগুতে পারছেন না। গ্রামীণ মহিলারা এত দিন কুটির শিল্পে তাদের মূল্যবান শ্রম দিতেন। কিন্তু যান্ত্রিক শিল্পের বিকাশ এবং পুঁজি সংকটের কারণে কুটির শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ২২ লাখ তাঁতী পরিবার এখন  আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু মাত্র টাঙ্গাইল , সিরাজগঞ্জ , নারায়নগঞ্জ , ও সোনারগাও এ নামমাত্র কিছু পরিবার টিকে আছে । এসব পরিবারের নারীরা তাদেও গৃহস্থালী  কাজ শেষে তাঁত শিল্পে সময় দিত । তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ নারীরা বেকার হয়ে যাচ্ছেন। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পুরুষ শাসিত গ্রামীণ সমাজে নারী স্বাস্থের বিষয়টি অবহেলিত। ফলে কন্যা-জায়া-জননীগন সব সময় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকছেন। অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর না হওয়ায় একজন গ্রামীণ নারী সন্তান নেয়ার ব্যাপারে যে মতামত দেয় তা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিকট গ্রহনযোগ্য হয় না। ২০০২ সালে ম্যাস লাইন মিডিয়া সেন্টার গ্রামীণ নারী বিষয়ে ভোলা জেলায় একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের ফলাফলে দেখা যায় শতকরা ৭৫% দরিদ্র গ্রামীণ নারী কাজের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে। তারা পেটের দায়ে সস্তায় শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়। মহিলাদের অগ্রগতির ব্যাপাওে এনজিওগুলো সামান্য কিছু সাফল্যকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে একজন মহিলা একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সে অন্য একটি এনজিও থেকে ঋণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এজন্য উচ্চ সুদের হার ,  ঋণ নেয়ার প্রথম সপ্তাহ থেকেই কিস্তি পরিশোধ , বীমা ও সঞ্চয় কেটে রাখা ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়। ডেনিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক টম হাইনম্যান বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপাওে একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করেন। এতে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হা জুন চেং এর উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয় -”ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে কখনও দারিদ্র থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব নয়। কারণ ক্ষুদ্র ঋণের সুদ ক্ষুদ্র নয়। ৩০-৪০ % এমনকি ১০০% এর বেশি হয়। দুনিয়ায় এমন কোন ব্যাবসা নেই যা থেকে লাভ দিয়ে মুনাফা করে সে ঋণের কিস্তি শোধ করা যাবে। পুরো ব্যাপারটাই এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন কেবল স্থানীয় মহাজনের সঙ্গে প্রতিযোগীতা করে তাদের হঠিয়ে ঋণের বাজারটি দখল করা যায়।”

এক জরিপে দেখা গেছে ১৯৮৯ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় বয়সী ছেলে ও মেয়ের ভর্তির অনুপাত ছিল ৯০ঃ৫০ , ১৯৯৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২.৬ ঃ৪৭.৪ , ২০০২ সালে ৫০.৫ঃ৪৯.৫ আর বর্তমানে সমানে সমান। মেয়েদের স্বাবলম্বীতার জন্য উচ্চ শিক্ষা অপরিহার্য। এজন্য ঝড়ে পড়া রোধ করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ২০০৩ সালে ঝড়ে পড়ার হার ছিল ৫৩.৪ বর্তমানে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ৪১.৫ শতাংশে। ইউনিসেফের জরিপে দেখা যায় ১৯৯৫ সালে ৫ শতাংশ মেয়ে উচ্চ শিক্ষা নিত আর এখন নিচ্ছে ১৯ শতাংশ। তৈরি পৈাশাক শিল্প বাংলাদেশের নারীদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হাতিয়ার। যদিও পোশাক শিল্পের কারখানাগুলো শহরে গড়ে উঠেছে তবে এগুলোর অধিকাংশ কর্মী গ্রামের। তাই গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে  অর্ধ শিক্ষিত ও অশিক্ষিত এই কর্মীদের অবদান অসামান্য। শহর থেকে যে অর্থ গ্রামে যায় তার সিংহভাগই পাঠায় গার্মেন্টসকমীরা। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও জাতীয় আয়ে নারীর অবদান ৩০ ভাগ। বর্তমানে ১৫-৫৫ বছর বয়সী বিশ্বের মোট নারীর ৪৫ ভাগ অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয়। চীন দেশে বর্তমানে ২ কোটি ৯০ লাখ নারী উদ্যোক্তা রয়েছে। যা দেশের মোট উদ্যোক্তাদের ২৫ শতাংশ। এদের মধ্যে ৪১ শতাংশ স্বাধীন ব্যবসায় ী বা বেসরকারী প্রতিষ্টানের মালিক। চীন দেশের সরকার ২০০৯ সালে  সে দেশের নারীদের কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। অল চায়না উইমেন্স ফেডারেশনের সহায়তায় চীন সরকার নারীদের বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা কওে দেয়। এ ঋণের সহায়তায় ৯ লাখ নারী নিজ উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করেন। এতে মোট ৪০ লাখ নারী কর্মসংস্থানে হয়। ফলশ্রæতিতে পরিবারের উন্নতিতে তাদের অবদান বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশে নারী জাগরণের অগ্রদুত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। তিনি তার এটি বইয়ে বলেন-উপার্জণ করিবনা কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই , না বুদ্ধি নাই , ?কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গ্রহকর্মে ব্যয় করি  সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিবনা?” একজন সফল নারী উদ্যোক্তা মৌসুমি ইসলাম । তিনি বলেন - বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষেই আমি পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করি। একটি মেয়ে সন্তান নিয়ে পুরোপুরি সংসারী হয়ে যাই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে তো   আর নারীদের মুক্তি নেই। তাই ২০০০ সাল থেকে ব্যবসায় প্রবেশ করি। বর্তমানে তা ৫টি প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে এবং ২০০৭ সাল থেকে একটি গ্রæপে পরিণত হয়েছে। আমি কোন প্রতিষ্ঠান পারিবারিক সুত্রে পাইনি । তিল তিল কওে গড়ে তুলেছি । তাকে দেখে অনেক নারী স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার কথা ভাবছেন । যদিও বিতর্ক রয়েছে তারপরও বলতে হয় ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর প্রায় ২৫০০০ কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ হচ্ছে। গ্রাম্য অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। এসব ঋণের অধিকাংশই দেয়া হচ্ছে নারীদের। গ্রাম্য নারীরা এ ঋণের মাধ্যমে জুতার দোকান , দর্জিও দোকান ,  মুদি দোকান ,  চায়ের স্টল ,  ফোনের দোকান ,  দিয়ে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছে। গ্রামীণ মহিলাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে শিক্ষকতা পেশাটি দারুণ ভুমিকা রাখছে। তারা এ পেশাটিকে অন্যান্য পেশার চেয়ে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত মনে করে।রসরকার শিক্ষকতায় নারীদের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ করছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলে ২০% এবং গ্রামাঞ্চলে ৩০% মহিলা কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ % পদ মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। এক জরিপে দেখা যায় - ১৯৯৫ সালে নারী শিক্ষকের হার ছিল ২৫ শতাংশ ২০০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.৫ শতাংশ আর বর্তমানে তা ৫০.৭ শতাংশ। 
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত গ্রামের মহিলারা সংসারের জন্য কাজ করেন। দুপুরে  খাওয়ার পর সুখ নিদ্রা যেতে পারেন সে রকম নারীর সংখ্যা খুবই কম। তবে সংসারের সকল কাজ তিনি একা করলেও তার অবদানকে সামান্যই স্বীকার করা  হয়। এটি খুবই দুঃখজনক । অনেক গৃহকর্তাকেই বলতে শোনা যায়  -রান্না-বান্না আর বাচ্চা-বাচ্চা দেখা-শোনা করা ছাড়া  সারাদিন আর কি করো? অথচ গিন্নি কোন সময় অসুস্থ হলে এ কাজটুকু করতেই সাহেবের বারটা বেজে যায়? নারীদের এ কাজ চিরায়ত। তবে বর্তমানে গ্রামীণ নারীরা সংসারের নিয়মিত কাজ করেও আয় বর্ধনমূলক কাজে নিয়োজিত থাকছেন। এতে সংসারে দুপয়সা অতিরিক্ত আসার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হচ্ছে। এতে সংসারে নারীদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পরিবেশের অভাবে অনেক নারী ইচ্ছে থাকা সত্বেও আয় বর্ধনমূলক কাজে অংশনিতে পারছে না।।সরকার বিভিন্ন সংস্থা  , এমনকি পরিবারের কর্তাদের উচিত কর্মক্ষেত্রে নারীদের অনুকুুল পরিবেশ গড়ে তোলা , এবং আমরা সবাই তাই করব ,  এই হোক ” গ্রামীণ  নারী দিবসের অঙ্গীকার।” 
লেখকঃ প্রভাষক, সাংবাদিক, কুমিল্লা  


Post a Comment

0 Comments