সমাজে তিনি একজন আদর্শ নারী, পরিবারে তিনি একজন মমতাময়ী মা, সংসারে তিনিই একজন সুগৃহিণী,এবং সাথে সাথে তিনিই একজন শিল্পোদ্যোক্তা।বর্তমানে এমনই গুণবান নারীর অভাব নেই বাংলাদেশে।
ক্ষুদ্র ঋণের কল্যাণে শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে বহু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। তবে আন্তর্জাতিক হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ১০ শতাংশের কম। উপযুক্ত পরিবেশ ও ঋণ সুবিধা পেলে প্রান্তিক নারীরা এ খাতে আগ্রহসহকারে এগিয়ে আসবে। কমিল্লার মেয়ে কুহিনুর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকার জন্য অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মতো বাবা কিংবা ভাইয়ের কাছে হাত পাততে হয়নি। ক্ষুদ্র চাষী ঈমান আলীর ছোট মেয়ে কুহিনুর। ৫ম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাকে সহযোগিতা করার জন্য শখের বসে একদিন সুঁই -সুতা হাতে তুলে ন্য়ে। সেই থেকে শুরু;তারপর তা নেশা হয়ে যায়। স্কুল থেকে ফিরেই চাদরে ফুল উঠানোর কাজে মনযোগ দেয়। সমবয়সী মেয়েরা যখন গোল্লাছুট আর কানামাছি নিয়ে ব্যস্ত তখন সে ফুলের বাগানের মালির মতো চাদরে ফুটিয়ে তুলছে গোলাপ আর জবার মতো বহু রং-বেরঙের ফুল। শুধু চাদর নয় রুমাল, কুশন কভার, সাইড ব্যাগ, থেকে মোবইল কভার কোথায় আঁচড় পড়েনি কুহিনুরের? সবকিছুতেই মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুল তোলে সে। যশোরের মেয়ে তাছলিমা আক্তার।সে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা । তার প্রতিষ্ঠান যশোর শহরে।তিনি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হস্তশিল্পের প্রদর্শনীতে অংশ নেন। এছাড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাটজাত পণ্য সংগ্রহ করে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। মাস্টার্স ডিগ্রি পাশ মেয়ে তো তো রাখাইন। তিনি চিন্তা করলেন কারো অধীনে চাকুরি না করে নিজেই কিছু করবেন। ইসলামী ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করলেন। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্রাক ,প্রশিকাসহ বহু এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পেল্ট্রি খামার করেছেন কারিমা, বুটিকের ব্যসা করছেন গৃহবধু সুপর্ণা আক্তার , চায়ের দোকান দিয়েছেন আলেয়া বেগম। এরকম লাখো লাখো নারী আজ ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন। বেসরকারি সাহায্যকারী সংস্থাগুলো নয় সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ,ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রান্তিক নারীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে। এব্যাপারে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ব্যবস্থাপক ও ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান জানান ,২০১১ সালের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ডঃ আতিউর রহমান ১০ নারী উদ্যোক্তার মধ্যে ঋণ বিতরণ করে এসএমই প্রজেক্ট উদ্ভোধন করেন। পিকেএসএফ নারীদের ঋণ প্রদানে বিশেষভাবে এগিয়ে এসেছে। অতি দরিদ্রদের জন্য বিশেষায়িত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের আওতায় ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৫ লাখ ২৮ হাজার ৫৮৯ জন উপকারভোগীর মধ্যে ৫ লাখ ২৭ হাজার ৬৩২ জন মহিলা উপকারভোগী অর্থাৎ মোট উপকারভোগীর ৮৯দশমিক ৭৪ শতাংশ নারী।
পরিসংখান অনুযায়ী ৬৫৬ টি বেসরকারি সংস্থা থেকে চলতি অর্থ বছরে ১ কোটি ১৬ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৪ জন নারী খণ পেয়েছেন। নারীদের ঋণপ্রাপ্তি সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ডঃ আতিউর রহমান বলেন- নারীরা তাদের ঋণ সৎকাজে খরচ করে। পুরুষের চেয়ে তাড়াতাড়ি ঋণ শোধ করে। ২০১০ সালের জুন মাস পর্যন্ত হিসেবে নিয়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়-দেশে ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই নারী। এসময় গ্রাহকগণ সঞ্চয় করেছেন ৫ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। এ ঋণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান হওয়ার পাশাপাশি তারা অর্থনীতিকেও গতিশীল করতে সক্ষম হয়েছে। দেশের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের পুরোটাই নারীদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ায় প্রান্তিক নারীদের আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে যাদের বাড়িতে কাঁচা পায়খানা ছিল এখন তারা স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যাবহার করছে , যাদের বাড়িতে বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা ছিল না এখন তাদের বাড়িতে আর্সেনিক মুক্ত টিউবওয়েল দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে পণ্য বাজারজাতকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নারীদের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তাদের নিকট পেঁছাতে সমস্যা হচ্ছে। তাদের পণ্য পানির দরে কিনে নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করছে। ফলে তারা তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফসল পাচ্ছেন না। দালাল-ফড়িয়া বাদে যদি সরাসরি ভোক্তাদের নিকট পণ্য পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তারা আরো অধিক লাভবান হতেন। তাদের ব্যবসা আরো অধিক প্রসারিত হতো; আরো নতুন নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার সৃষ্টি হতো। নারী উদ্যোত্তাদের আরেকটি প্রধান সম্যা হচ্ছে মূলধনের সল্পতা, এছাড়া আমাদের সমাজ , পরিবার, পরিবেশ, পরিস্থিতি এখনও নারীদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার উপযোগী নয়। এক জরিপে দেখা গেছে ৩৫ শতাংশ নারী মনে করেন তার উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পেছনে আনেক বাধা রয়েছে, তবে ৮৮ শতাংশই মনে করেন তাদের প্রধান বাধা হচ্ছে মূলধন। বাংলাদেশে পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। সাধারণত পরিবারের কর্তা এখানে বাবা। বাবার অবর্তমানে মা সংসারের হাল ধরেন। এসব পরিবারে ঋণের প্রয়োজন বেশি। তারা ঋণ পেলে অন্যের দ্বারস্থ হয়ে নিজেরাই একটা কিছু করতে পারেন। অকাল মৃত্যু , দুর্ঘটনা, কিংবা বিদেশেগমনের কারণে আমাদের দেশে নারী প্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। বিএডিসির এক গবেষণায় জানা যায় দেশে নারী প্রধান পরিবার যত বাড়ছে , ঋণের পরিমাণ তত বাড়ছে। নারী প্রধান পরিবারের ৬০ ভাগ কোন না কোন সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহন করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ১০ শতাংশ ঋণ প্রদানের নির্দেশ দিলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তা মানছেনা বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে দেশে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা কাঙ্খিত পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরে এসএমই খাতে বিতরণকৃত ঋণের তিন শতাংশ নারীদের দেয়া হয়েছে। এসম্পর্কে ব্যাংকগুলোর দাবি মহিলা উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। মহিলা উদ্যোক্তারা দাবি করেন ব্যাংক তাদের ঋণ প্রদানে অনিহা প্রকাশ করছে। নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নারী উদ্যোক্তারা ঋণের সুদের হার কমানো , ঋণের গ্রেস পিড়িয়ড কমানো, গ্যারান্টির শর্ত শিথিল করা , ট্রেড লাইসেন্স ও টিআইএন নম্বর প্রাপ্তি সহজ করা ও স্বামীর গ্যারান্টি ছাড়া সহজে ঋণ প্রদানের দাবী জানান।লেখকঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য ক্যাম্পেনার।
0 Comments